কালি কলম মন
পূর্ণেন্দু পত্রী
২০০.০০, প্রতিক্ষণ
একদা একটি সাময়িকপত্রে ‘কালি কলম মন’ নামেই ধারাবাহিক ফিচার লিখতেন লেখক। দেশজ ভাষায় ভিনদেশি শিল্পী-সাহিত্যিকদের সৃষ্টি নিয়ে সে সব লেখায় একই সঙ্গে তথ্য ও অনুভূতির সমাহার হয়েছিল। রচনাদির মধ্যে ফুটে উঠত চিত্র-ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র, সাহিত্যের শিল্পরীতি নিয়ে তাঁর নিরন্তর পর্যবেক্ষণ ও অভিব্যক্তি। পাঠকের কাছে বাড়তি পাওনা ছিল তাঁর চমৎকার গদ্য। সেগুলিই গ্রন্থিত করেছেন সম্পাদক অরুণ সেন। শুরুতেই তিনি পূর্ণেন্দু পত্রীর সৃজনকর্মের বিচরণক্ষেত্র কতটা ব্যাপক তার পরিচয় দিয়ে প্রাবন্ধিক পূর্ণেন্দু সম্পর্কে লিখছেন: ‘‘পূর্ণেন্দু-র প্রবন্ধ-প্রীতির কথা যা জেনেছি, তা কিন্তু তাঁর তারুণ্যের কাল থেকেই। ক্রমশই দেখেছি সেদিকেই তাঁর বেশ নজর। প্রবন্ধ পড়েছেন এবং লিখেছেন তাঁর ওই আশ্চর্য ব্যস্ত বহুমুখী সৃজনশীলতার মধ্যেই।... সবই তাঁর আগ্রহের এক-একটা বড়ো এলাকা, এবং তা নিয়েই প্রবন্ধ ও প্রবন্ধের বই।’’ রাফায়েল, ভ্যান গঘ, রঁদ্যা, দালি, হাইনে, অডেন, এজরা পাউন্ড, বুনুয়েল, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ... এ রকম কে না উঠে এসেছেন পূর্ণেন্দুর কলমে! লিখেছেন আধুনিক গ্রন্থচিত্রণ নিয়ে, লিখেছেন কলকাতার দেয়াল-লিখন নিয়েও: ‘‘কলকাতার দেয়াল-লিখন খুলে দিতে পারে গবেষণার আরও একটা বড়ো দরজা।... ১। স্বাধীনতা-পূর্ব দেয়াল-লিখনের ধরন-ধারণ; ২। স্বাধীনতা-উত্তর দেয়াল-লিখনের আকৃতি-প্রকৃতি; ৩। দেয়াল-লিখনের সঙ্গে দেয়াল-চিত্রের ক্রম-অবিচ্ছেদ্যতা। আবার ইচ্ছে করলে দেয়াল-লিখনকেও ভাগ করে নিতে পারেন দু ভাগে। প্রথমটা গদ্যের, দ্বিতীয়টা পদ্যের অথবা ছড়ার।’’
বিপ্লবী সূর্য সেন ও সৌর পরিবার
আশিস্ সরকার
৪৫০.০০,সাগ্নিক বুকস
সহযোদ্ধা কল্পনা দত্তের ভাষায়, ‘‘বিপ্লবী নেতার কথা ভাবতে গেলে সাধারণত যে চেহারাটি ভেসে ওঠে, মাস্টারদা মোটেই তা ছিল না। রোগা, ছোটখাট, স্বল্পভাষী, অমায়িক মানুষটাকে দেখলে বোঝার উপায় ছিল না মানুষটা কোন জাতের।’’ চট্টগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠনের অবিসংবাদী নায়ক, মাস্টারদা সূর্য সেন (১৮৯৪-১৯৩৪) কী ভাবে বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত হলেন, নেতৃৃত্বে এলেন, তৈরি করলেন বিশ্বস্ত অনুগামীদের বাহিনী, তার সব খুঁটিনাটি সহজলভ্য নয়। বিশ শতকের সূচনায় চট্টগ্রামের পরিমণ্ডল, সূর্য সেনের উত্থান, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, ফেণী জালালাবাদ ফিরিঙ্গিবাজার কালারপোল চন্দননগর থেকে ধলঘাট গৈরালা গহিরা সংঘর্ষের বিস্তারিত বিবরণ, মামলা ও বিচারে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি, সবই সঙ্কলন করেছেন লেখক। শেষে যোগ করেছেন ‘সৌর পরিবার’-এর ইতিবৃত্ত— সূর্য সেনের ২০৪ জন সহযোগীর কথা। তাঁর মধ্যে আছেন কল্পনা দত্ত (যোশী), যাঁর বিচার হয় সূর্য সেনের সঙ্গেই, কিন্তু কম বয়েস ও মেয়ে বলে ফাঁসির বদলে দ্বীপান্তরের আদেশ হয়। মহাত্মা গাঁধী ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদে সেই আদেশ স্থগিত করে কারাদণ্ড হয়, মুক্তি পান ছ’বছর পর। সেই মুক্তির পিছনেও রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল।
সচলতার গান
বিশ্বজিৎ রায়
২২৫.০০, সূত্রধর
পঁয়ত্রিশটি বিভিন্ন সময়ের লেখা, পাঁচটি গুচ্ছে সাজানো। লেখকের মতে, ‘‘বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে নানা কথা’’, যেন ‘‘পল্লবগ্রাহী এক আড্ডাবাজের’’ কথনে। কিন্তু এই মন্তব্য নিতান্তই বিনয়। আড্ডার সঙ্গে মিল আছে তাঁর লেখার তরতর করে বয়ে যাওয়ায়, আর শ্রোতার মনকে চট করে ছুঁয়ে নেওয়ার অনায়াস দক্ষতায়। বিষয়বৈচিত্রে তা অকূল দরিয়া, রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ সেখানে দুটি উজ্জ্বল দিকচিহ্ন। তবে সেখানেও চর্বিতচর্বণ নয় মোটেই— রবীন্দ্রসঙ্গীতের পরিবেশ, প্রেমের গান প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ দত্ত ও রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি পড়ানো, রক্তকরবীর ভিতরের গল্প, রবীন্দ্রনাথের নেশন ও সমাজ ভাবনার নানা দিক, সুচিত্রা মিত্র ও রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিনলিপিতে ‘রবীন্দ্রনাথহীন শান্তিনিকেতন’-এর ছবি, বিবেকানন্দ ও তাঁর লেখালিখিকে নতুন করে দেখা-পড়ার নানা অভিমুখ— তথ্যের ভারকে লেখার বুনটে আড়াল করে রেখে চিন্তা উস্কে দেওয়ার বিপুল উপকরণ। এর সঙ্গে আছে বাংলা ভাষা শিক্ষার নানা পর্বের কথা, শিলঙের বাঙালি প্রকাশক বিভূভূষণ চৌধুরী ও তাঁর প্রকাশনা চপলা বুক স্টলের কথা, কিংবা সজনীকান্ত দাসের ‘আধুনিকতা’, তারাশঙ্করের গ্রামদর্শন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় দীনেশচন্দ্র সেন অশোক সেন কি গৌতম ভদ্রের প্রসঙ্গ। এমনকি শেষ পর্বে বিশ্বজিৎ পাঠককে নিয়ে আসেন ছোটদের লেখার ভিন্নমুখী বিশ্লেষণের সামনে— ইস্কুলের গল্পে, সত্যজিতের শঙ্কুর সন্ধানে, টেনিদা আর ফেলুদার কাহিনিতে বাঙালির পাড়া-সংস্কৃতির বিবর্তনের চট করে নজরে না পড়া ছবিটার খুঁটিনাটিতে। এত বড় ক্যানভাস দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যায়, ঘোর কাটলে বোঝা যায় রামমোহনের ‘মননের স্বরাজ’ থেকে ‘সেলুলার ও সেলফি’ পর্যন্ত বাঙালি মনের দিন ও দিকবদলের কত না হদিশ দিয়ে গেল এই সংহত সঙ্কলন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy