দিল্লি নিবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতি-সম্পন্ন প্রখ্যাত শিল্পী রামকুমারের একগুচ্ছ সাদা-কালো ড্রয়িং নিয়ে প্রদর্শনী হল সম্প্রতি আকৃতি আর্ট গ্যালারিতে। গাঠনিক বিমূর্ততার সমৃদ্ধ দৃষ্টান্ত এই রচনাগুলি শিল্পীর ১৯৬০-৬১ সালের কাজ। কোথাও দেখানোর বা প্রদর্শনী করার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। এত দিন কোথাও দেখানোও হয়নি এই ছবি। সেই পুরোনো ড্রয়িং খাতা উদ্ধার করে আকৃতি গ্যালারিই প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে এল এই ড্রয়িংগুলি, যার ভিতর শিল্পী তখন খুঁজেছিলেন নিরবয়বের নিজস্ব ভাষা। এই প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করেছেন দিল্লিনিবাসী বিশিষ্ট কবি ও শিল্প-তাত্ত্বিক প্রয়াগ শুক্লা।
রামকুমার ১৯৪০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত ভারতের আধুনিকতাবাদী চিত্রধারার অত্যন্ত বিদগ্ধ একজন শিল্পী। বিগত প্রায় সাত দশক ধরে তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তার জন্ম ১৯২৪ সালে শিমলায়। ১৯৪৫ সালে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৪৪-৪৫-এই ছবি আঁকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা। প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন শৈলজ মুখোপাধ্যায়ের কাছে। ১৯৫০ সালে প্যারিসে যান। ১৯৫২ পর্যন্ত সেখানে আঁন্দ্রে লোহতে ও ফারনান্দ লেজে-র কাছে শেখেন। ১৯৭০-এ একটি ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকায় যান। সাহিত্যিক হিসেবেও রামকুমার বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন। হিন্দিভাষার একজন অত্যন্ত মননশীল গল্পকার তিনি। তাঁর সাহিত্য ও চিত্রের মধ্যে প্রত্যক্ষ কোনও সংযোগ নেই। পরোক্ষ যে যোগ তা অনেকটা গাঠনিকতার। আর্নস্ট হোমিংওয়ে একবার বলেছিলেন চোখ দিয়ে লেখার কথা, সেজান বা অন্যান্য ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি দেখে তিনি যা শিখেছিলেন। রামকুমারের গল্পে রয়েছে সেই গাঠনিকতার ব্যবহার। ছবিতে তিনি অবশ্য আখ্যান-নিরপেক্ষ থাকতে চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য নির্ভরতা থেকে বের করে এনে বিমূর্ত এক ধ্রুপদী বোধকে সঞ্চারিত করেছেন। আলোচ্য ছবিগুলি এই পরিচয়েই সমৃদ্ধ।
শিল্পী জীবনের শুরুতে রামকুমার অবয়বী ছবি আঁকতেন। ১৯৬০-এর দশক থেকে নিরবয়বের দিকে চলে আসেন। বেনারস নিসর্গ নিয়ে এক সময় কাজ করেছেন। এই পর্যায়ের ছবি থেকেই তাঁর অবয়ব বিমূর্তায়িত হতে থাকে। ক্রমান্বয়ে তিনি চলে যান নাগরিক নিসর্গের বিমূর্তায়নের দিকে। সেখানে গাঠনিকতার বিন্যাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয়ে ওঠে তাঁর প্রধান অন্বিষ্ট। আলোচ্য ছবিগুলিতে রয়েছে তারই বিভিন্ন ধরনের অনুশীলন।
এখানে শিল্পী কাজ করেছেন কেবলমাত্র রেখা নিয়ে। কাগজের শুভ্র শূন্য সীমাবদ্ধ নির্দিষ্ট পরিসরের উপর একটি কালো রেখার আঁচড় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় শূন্য পরিসরের সঙ্গে টানাপড়েনের খেলা। যা অনেকটা নৈঃশব্দের বুকে সুরের অভিসারের মতো। একটি রেখার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে বিভিন্ন মাত্রার ও বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের অজস্র রেখা। তাদের পারস্পরিক বিন্যাসের মধ্য দিয়ে নানা ধরনের বুনোট তৈরি হতে থাকে। গড়ে ওঠে রূপের এক একটি একক। এই এককগুলিই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে গ্রথিত হয়ে গড়ে তোলে সামগ্রিক একটি প্রতিমাকল্প। তাতে কখনও কখনও ভেসে ওঠে প্রকৃতির কোনও অনুষঙ্গ। দর্শক তাঁর নিজের দেখার ধরন দিয়ে তা তৈরি করেন। শিল্পীর সে রকম কোনও অভিপ্রায় থাকে বলে মনে হয় না। তাঁর কাছে সবটাই প্রকৃতি নিরপেক্ষ বিশুদ্ধ রূপ তৈরি করার প্রয়াস মাত্র। হয়তো বা স্মৃতির প্রকৃতিকে বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র এক প্রকৃতি গড়ে তোলার অভিপ্রায়। এখানে তিনি রূপের জন্যই রূপের স্রষ্টা। রূপকে কোনও সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের দিকে চালিত করতে চান না।
ভারতের আধুনিক চিত্রকলায় বিমূর্ততার প্রথম পদপাত ঘটে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। ১৯২০ থেকে ১৯২৫-এর মধ্যে করা তাঁর তথাকথিত কিউবিস্ট অনুষঙ্গের ছবিতে রূপকল্পকে তিনি জ্যামিতিক ভাবে আলোছায়ার দ্বৈতে বিশ্লিষ্ট করেছিলেন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘পূরবী’-র পাণ্ডুলিপি কাটাকুটির মধ্য দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন রূপের স্বতন্ত্র সংবিত, অনেক সময়ই তাতে নিরবয়বের পদপাত ঘটছিল। ১৯৪০-এর দশকের শিল্পীদের মধ্যে বিমূর্ততা চর্চার দুটি ধারা লক্ষ করা যায়। একটি জীবননির্ভর। রামকিঙ্কর ও সোমনাথ হোরের ছবি এর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। আর একটি জীবন বা প্রকৃতি নিরপেক্ষ। গাইতোণ্ডে বা সৈয়দ হায়দর রাজার মতো রামকুমারও সেই ক্ষেত্রটিকে বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy