Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

খোলা হাওয়ার মাংস-বিলাস

এমন মাংস ছাড়া ক্রিসমাস বা নতুন বছরকে ক্রিসমাস বা নতুন বছর বলে মনেই হয় না। লিখছেন ঋজু বসুচাইলে ধোঁওয়া ওঠা, ফোটানো জলে ঢিমে আঁচে ফুটিয়েই এ সসেজ দিব্যি সাত-সকালের টোস্ট-স্যান্ডউইচের সঙ্গে সাবড়ে ফেলা যেতে পারে! কিন্তু পার্কসার্কাস বাজারের খানদানি খটিকবংশের উত্তরাধিকারীরা এমন কাজ করতে দেখলে বেজায় ব্যথিত হবেন। গূঢ় ফর্মুলার রহস্যঘন গরম মশলার কম্বিনেশনে সেই ধ্রুপদী পর্ক সসেজকে সম্ভ্রম দেখাতে হলে, ভাতের কোনও বিকল্প নেই। লিখছেন ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৬:০৮
Share: Save:

চাইলে ধোঁওয়া ওঠা, ফোটানো জলে ঢিমে আঁচে ফুটিয়েই এ সসেজ দিব্যি সাত-সকালের টোস্ট-স্যান্ডউইচের সঙ্গে সাবড়ে ফেলা যেতে পারে! কিন্তু পার্কসার্কাস বাজারের খানদানি খটিকবংশের উত্তরাধিকারীরা এমন কাজ করতে দেখলে বেজায় ব্যথিত হবেন।

গূঢ় ফর্মুলার রহস্যঘন গরম মশলার কম্বিনেশনে সেই ধ্রুপদী পর্ক সসেজকে সম্ভ্রম দেখাতে হলে, ভাতের কোনও বিকল্প নেই। নিয়মমাফিক গরম জলে মিনিট ২০-২৫ উল্টেপাল্টে ফোটানোর পরে মুখে তোলার আগে একটু সবুর করেন। সামান্য পেঁয়াজকুচিযোগে এ সসেজ ভেজে ফেলুন সর্ষের তেলে। খাঁটি রসিকদের নিদান: হ্যাঁ, সর্ষের তেলের সোয়াদেরও জবাব নেই এ ক্ষেত্রে। এর পরে পর্কের নিজস্ব তেল আর সর্ষের তেলের আস্বাদ ভাতে মেখে খেতে-খেতে আরামে চোখ বুজে আসবেই!

জোর গলায় এমন গ্যারান্টি দিলেও ঠাকুরদার আমল না কি তাঁরও ঠাকুরদার আমল থেকে চলে আসা মন্ত্রগুপ্তি হাজারো টোপ দিলেও বাইরের লোকের সামনে ভাঙবেন না পার্কসার্কাস বাজারের রাহুল খটিক। সবে পঁচিশ পেরোতে না-পেরোতে পারিবারিক ট্রেড সিক্রেট তাঁকেও পাখিপড়া পড়তে হয়েছে।

ধবধবে সাফসুতরো টেবিলে ফেলে সসেজ গড়ার সময়ে পেঁয়াজ-পার্সলি, পুদিনা, আদাকুচির সঙ্গে গরম মশলার যে মোক্ষম কম্বিনেশনটা মেশানো হবে, তার ফর্মুলা মহার্ঘ খানদানি সম্পদের মতো আগলে রেখেছে আগরাওয়ালা ঘরানার এই খটিকেরা। তবে কসাইগিরির জাতব্যবসায়ীর সসেজ-শিল্পী হয়ে ওঠা এই কলকাতার হাওয়া লেগেই। গত শতকের চল্লিশের দশক থেকেই পুরণলাল খটিকের বিখ্যাত পর্ক সসেজের নামডাক পার্কসার্কাস-বেকবাগান তল্লাটময় রসিক-মহলে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পুরণলাল তস্য পুত্র চমনলালের জমানা পেরিয়ে তাঁর বড়ছেলে দেবকুমার ও ছোট ছেলে রাহুলই সেই পারিবারিক পর্ক সসেজের স্বত্ত্বাধিকারী।

দক্ষিণ কলকাতার জামির লেনের বিখ্যাত ও’ব্রায়েন পরিবার, টালিগঞ্জের বহু নামজাদা অভিনেতা-পরিচালক থেকে কলকাতার বাঁড়ুজ্জে-চাটুজ্জে-বোস-ঘোষ অনেকেই এ সসেজের একনিষ্ঠ লয়্যালিস্ট। এমনকী, যশোহর-খুলনার কোনও কোনও রসিকও কাঠখড় পুড়িয়ে কলকাতায় আসেন এই মহার্ঘ মাংসের টানে। পার্কসার্কাসে ব্যাগ ভরে এ কলকাত্তাইয়া ভেতো সসেজ বোঝাই করে, অতঃপর গন্তব্য ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। ক্যালম্যান কোল্ড স্টোরেজে অভিযান। স্যান্ডউইচের প্রাণভোমরা মিট লোফ সেখানেই সংগ্রহ করে নিতে হয়। কাকোরি কাবাবের চেয়েও মিহি কুচোন পর্ক বা বিফের এই কিমা দন্তহীন বৃদ্ধও লজেন্সের মতো চুষে খেয়ে ফেলবেন। ডিম-মাখন-লেটুস-বিন্‌স থেকে কত কী যে এই থকথকে মাংসের পেস্টের শরীরে মিশে যায়, তা কালম্যানের ভিতরের লোকেরা ছাড়া ভূভারতে কেউই জানেন না।

শুধু মাংস না-বলে মাংস নিয়ে এই বিচিত্র কসরতের সৃষ্টিকে অবিশ্যি মাংসের মোরব্বাও বলা যায়। হাঙ্গারিয়ান সাহেব কালম্যান গোহারির শিল্পঘরানা এখন ধরে রেখেছে একদা তাঁর ডানহাত বিষ্ণুপদ ধরের পরিবার। বিষ্ণুবাবুর স্ত্রী রুমাদেবী রোজই দোকানে বসেন। আর জামাইবাবুর হাতে-গড়া শ্যালক জয় ঘোষ দশ হাতে সব-কিছু সামলান। রোজ সকালে দোকানে গণেশ ঠাকুরের ছবিতে ঢিপ করে পেন্নাম ঠুকে দোকান খোলা ইস্তক, খদ্দেরদের সঙ্গে বাতচিত, কারিগদের পরিচালনা, সাপ্লায়ারদের থেকে সেরা মাংস জোগাড় করা— সব কিছুই জয়ের নেতৃত্বে। তাঁর ভাগ্নী আগমনীও দ্রুত পোক্ত হয়ে উঠছেন। মিট লোফ কি হাঁসের লিভার পাতে কি বিফের সল্টমিটের ফর্মুলা, এ-সবে কলকাতায় কালম্যানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। গোলমরিচ-মৌরি-ধনের সঙ্গে জয়িত্রীর হাল্কা মোচড়ে হাঁসের লিভারের পেস্ট আলাদা প্রাণ পায় কালম্যানে। কিংবা সাত দিন ধরে লেবুর রস, মল্ট ভিনিগার, আখের গুড়টুড়ের অব্যর্থ কম্বিনেশনে মজানো উপাদেয় বিফের টুকরোর সল্ট মিট চাখলে বহু অ্যাংলো, গোয়ান বা বাঙালি ক্রিশ্চান ঘরের প্রবীণেরও গত জন্মের স্মৃতিতে টান পড়ে। বাড়িতে তরিবত করে এ-সব আশ্চর্য সৃষ্টিতে দড়ো আন্টি কি গ্র্যানিদের কথা মনে পড়ে যায়।

আগের কলকাতায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহল্লায় তাজা রক্তেরা অনেকেই দেশান্তরী। পাড়া ক্রমশ বৃদ্ধাশ্রম। তাই ভরসা কালম্যান কিংবা পার্কসার্কাস-নিউমার্কেট বাজারের দু’-একটা ঠেক। এ সব দোকান বছরভর খোলা থাকলেও এ শহরে বিরল অতিথি শীতের ছোঁয়ায় এই সব মাংসের মহিমা অন্য মাত্রা পায়। নিষিদ্ধ ‘কাবাব ভরপেট’-এর টানই হোক কিংবা স্যান্ডউইচে মাংসময় বিনোদন— এ-সব ভোজ-বিলাসের জন্য শীতই হল মাহেন্দ্রযোগ। এমন মাংস ছাড়া তাই কারও কারও ক্রিসমাস বা নতুন বছরকে ক্রিসমাস বা নতুন বছর বলে মনেই হয় না।

গোটা ভারতই যখন শপিংমলে মজুত সিন্থেটিক প্রসেস্‌ড মিটের স্বাদে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে, তখন কালম্যান কি পার্কসার্কাস বাজারের খটিকদের পর্ক শপের মাংসের স্বাদ দুর্লভ ব্যতিক্রম। এ কালে বিলেতেও বিভিন্ন শপিংমলে ইন্ডিয়ান বিপণিরই রমরমা। সেখানেও এ-সব নিষিদ্ধ মাংসের সহজে দেখা মেলে না। তাই কারও কারও চোখে এ হল, কলকাতার বুকে এক টুকরো ইউরোপ। এবং এ কলকাতার স্পাইসি বিফ কলার বা পর্ক সসেজ ঘাড় সোজা করে স্পেন-জার্মানির বিখ্যাত চোরিজোরও চোখে চোখ রাখতে পারে।

শীত-পার্বনের টার্কি বা রাজহাঁসের হদিস পেতেও কালম্যানই অনেকের ভরসা। সে-কালে কলকাতার কোনও কোনও বাঙালি ক্রিশ্চান বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরে ডায়মন্ড হারবার কি মেদিনীপুর-বাঁকুড়ার কোনও অখ্যাত গ্রাম থেকে পোলট্রি চাষিরা নানা সাইজের পক্ষীসমেত হানা দিতেন শীত পড়লেই। ইলাহাবাদ থেকে অরবিন্দ খটিকও এ শহরকে কাঙ্ক্ষিত টার্কি সরবরাহ করতেন। ম্যাকলয়েড স্ট্রিটের ওয়ারেন টাকার বা দমদম ক্যান্টনমেন্টের ফ্রান্সিস গোমসরা পাখিটি পেয়েই পেটের ভেতর কাজু-কিসমিস-আখরোট থেকে শুরু করে চিকেন-বিফ-পর্ক-বেক্‌নের রকমারি মাংসকুচি ঠেসেঠুসে পেট সেলাই করে আভেনে রোস্ট করতেন। কলকাতার কয়েকটি পাঁচমিশেলি পাড়ায় পাঁউরুটির চেনা বেকারিতেও আভেনে টার্কি, রাজহাঁস কি শূকরশিশু রোস্ট করাতে সজ্জন গৃহস্থের লাইন পড়ত। কালম্যানের সৌজন্যে ও-সব ঝকমারি থেকে রেহাই মিলেছে।

তবে এ সময়ে যা লাইন ভাগ্যবান গৃহস্থই অনেক আগেভাগে হত্যে দিয়ে হয়তো বাড়ি বয়ে সেই রোস্ট নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু অনেকেই খেয়াল রাখেন না, নামজাদা ক্লাব, রেস্তোরাঁর ডিনারের ‘টার্কি ইন ক্র্যানবেরি সস’ বা ‘ডাক রোস্ট উইথ অরেঞ্জ সস’ আদতে কালম্যানেরই সৃষ্টি।

বড়দিনের দিন তিনেক আগে ভরদুপুরে কালম্যানের চিলতে দোকানঘরের লাইনে কাঁকুড়গাছির অ্যাম্বেট দম্পতির দেখা মিলল। ক্যালকাটা গার্লস স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা সবার প্রিয় শ্রীমতি অ্যাম্বেট আদতে বিহারি। তাঁর কত্তামশাই পেশায় ব্যবসায়ী ভিক্টর কেরলের লোক। কিন্তু আজন্ম কলকাতায় কাটিয়ে বাংলা মাধ্যম স্কুলে লেখাপড়া শিখে ভিক্টরের মতো বাঙালি এ শহরে কমই মিলবে। স্বামীর প্রভাবে স্ত্রীও সারা ক্ষণ বাংলাতেই কথা বলেন। বলছিলেন, বড়দিনের আগে কালম্যান ছাড়া ভাবতে পারি না! ছোট মেয়ে এবং জামাই ক্রিসমাসে আসছেন বেঙ্গালুরু থাকে। মরাঠি ব্রাহ্মণ জামাইটি আবার মিটলোফ-অন্ত-প্রাণ। বলে দিয়েছেন, ও-জিনিস সারা দেশেই আর কোথাও মেলে কি না, সন্দেহ।

আখাম্বা শপিংমল-মাল্টিপ্লেক্স থেকে নামজাদা ফুডচেনের রেস্তোরাঁয় যখন একধরনের এক ঢালা খাদ্যরুচিই ক্রমশ জেঁকে বসতে চলেছে, তখন কলকাতার বুকে এমন দু’-একটি খোলা হাওয়ার পরিসর টিকে আছে বলেই যেন আ-রাম সে নিঃশ্বাস ফেলা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE