Advertisement
E-Paper

সেই পয়লা বৈশাখ কেউ ফিরিয়ে দেবে না

চরিত্র গেলে সবই চলে যায়! পয়লা বৈশাখও হয়ে যায় এক একলাপনার উৎসব। লিখছেন শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়চরিত্র গেলে সবই চলে যায়! পয়লা বৈশাখও হয়ে যায় এক একলাপনার উৎসব। লিখছেন শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:২৩

চান ঘরে গান। আর অবিরাম বারিধারায় সেই নিখুঁত জলতরঙ্গ। বাবা প্রিয় গানটা গাইছে, ‘কী রবে আর কী রবে না, কী হবে আর কী হবে না/ওরে হিসাবি, এ সংশয়ের মাঝে কি তোর ভাবনা মিশাবি’? মা রান্না করছে। হরেক মশলাপাতির গন্ধমাখা মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছি সে দিনের সেই এইটুকুনি আমি। মা এতক্ষণ বাবার গান শুনছিল। বাবা এ বার গানের শুরুর চরণে ফিরতেই মা গলা মেলাল, ‘ওরে, নূতন যুগের ভোরে/দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে।’

প্রভাতের পয়লা বৈশাখের প্রথম ভাগ। আমরা তিন ভাইবোন বাবা-মা’কে প্রণাম করব। এর পর বাবা-মায়ের বন্ধুবান্ধবীরা আসবে আমাদের বাড়িতে। ক্ষুদিরাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে জিলিপি, মালপোয়া আর সিঙারা আসবে। শুরু হবে বৈঠকি আড্ডা, সঙ্গে গানবাজনা। এর পর একটা উষ্ণতর দুপুর আসবে, শুধু আমাদের জন্য। খাবার টেবিলে। হাতে খাবার শুকিয়ে যাওয়া আড্ডা। লক্ষ্মীবিলাস ধানের গরম ধোঁয়া-ওঠা ভাত, গাওয়া ঘি দিয়ে সোনামুগের ডাল, ঝুরি ঝুরি আলুভাজা, মেশানো তরকারি, পেঁয়াজ-ছাড়া পাঁঠার মাংস, খাঁটি গরুর দুধের পায়েস, আর পাবনা সুইটস থেকে রসকদম্ব-চমচম! ছুটির দিনে বাবা তখনও খাইয়ে দিত আমাকে। ওই খাবার টেবিলে বসেই আমি ‘বাংলার ছয় ঋতু’ শিখেছিলাম মায়ের বলা আরযায়, ‘একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ, পাঁচে পঞ্চবান, ছয়ে ঋতু...’। হেমন্ত, শরৎ, বসন্ত...সব গুলিয়ে ফেলতাম আমি বার বার। এ বার মুখে পান নিয়ে বাবা বসবে বিছানার ওপর, বালিশে হেলান দিয়ে। আমাকে কোলে বসিয়ে বাবা ‘বাংলার বারোমাস’-এর কথা শোনাবে। কী মিষ্টি মিষ্টি নাম সব। আষাঢ়, শ্রাবণ, অগ্রহায়ণ...তারপর কী যেন বাবা, তার পর? বাবা আবার বলত সব, বলত, ‘আজ বছর শুরু, আজ পয়লা বৈশাখ!’ শুনতে শুনতে দু’চোখে স্বপ্ন নেমে আসত আমার। বাবার কোলে ভাতঘুমে ঢলে পড়তাম আমি। ঘুম ভাঙলেই হালখাতা।

পয়লা বৈশাখের দ্বিতীয় ভাগ। বিকেলে মা আমাদের তিন ভাইবোনকে সাজিয়ে দিত। এ বার আমরা সবাই মিলে বেরিয়ে পড়ব, এ পাড়ায় সে পাড়ায়, এ দোকানে সে দোকানে। সব দোকানে ফুলমালায় সাজানো গণেশের মূর্তি। দোকানিরা বাবা-মায়ের হাতে উপহার হিসেবে খাবারের প্যাকেট তুলে দিত। আর ফাউ হিসেবে আমাদের বাচ্চাদের হাতে দিত রঙিন বাংলা ক্যালেন্ডার। কারণ, বাচ্চারা ‘রঙিন ছবি’ ভালবাসে! আর বড়রা, বড়রা কী ভালবাসে? কিচ্ছু না। বড় হলে সব ভালবাসার জিনিস হারিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায়! বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনে উঁকি মারে কিছু সোনালি দুঃখ! মনে আছে, সেটা ছিল বাবার সঙ্গে আমাদের শেষ পয়লা বৈশাখ। প্রণাম করার পর বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিল, ‘অনেক বড় হতে হবে কিন্তু সোনা বাবা আমার!’ বাবা, ‘আমি আর কত বড় হব? আমার মাথা এই ঘরের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়’ সেই পয়লা বৈশাখ ফিরিয়ে দেবে? আমাকে কে ফিরিয়ে দেবে সেই ছয় ঋতুর আরযা, সেই বাংলার বারোমাস। বাংলা বর্ণমালার বর্ণক্রমের মতোই আমি যেন ভুলে ভুলে যাচ্ছি বাংলার ছয় ঋতুর নানা মাসের ক্রমতালিকা! কোন দুই মাস নিয়ে হেমন্ত, বাবা? মা, অগ্রহায়ণটা কোন ঋতু?

মার্কিন মুলুকে, এই সুদূর পরবাসে, আমরা বাঙালিরা, তথাকথিত পয়লা বৈশাখের কাছাকাছি কোনও একটা হপ্তান্তে মিলিত হই। সে এক নরক গুলজার। চৈত্রসেলের সেই আপন আপন ব্যাপারটা আর নেই, সব যেন কেমন সাজানোগোছানো বুটিক! যেন অনুষ্ঠানটাই সব, যেন পয়লা বৈশাখের কোনও আত্মা নেই। পয়লা বৈশাখ একটা ছুটির দিন মাত্র, যে দিন হরেক রকম শাড়ি, পাঞ্জাবি আর কুর্তির প্রদর্শনী হবে! দেখা হলেই মুষ্টিমেয়রা বলবে, ‘শুভ নববর্ষ’, আর বেশির ভাগ সাহেবসুবো বাঙালি বলবে, ‘হ্যাপি পয়লা বৈশাখ’! পেট-পুরে খাওয়াদাওয়া, সঙ্গে চাট্টি গানবাজনা আর নাচ। গান-টান, নাচ-টাচ অবশ্য বাংলায় না হলেও চলবে, হিন্দি-ইংরেজি সব চলবে। হোয়াট স্পেশাল ইন ‘বং’ গাইজ! আমাদের না-ঘরের না-ঘাটের উদ্বাস্তু প্রজন্মের কাছে আমরা একটা জগাখিচুড়ি কালচার তুলে দিয়েছি। মুখটুক বেঁকিয়ে কোনওমতে তারা বলবে, ‘হোয়াটস দ্যাট, সে ইট এগেন, ফয়লা বাইশাক’!

আর আমরা? আমেরিকার বিত্ত বিলাস বিদ্যা বৈভবে বিভ্রান্ত ‘বড় হয়ে যাওয়া’ বাঙালি, আমরা বাংলা তারিখ ভুলে গেছি, ভুলে গেছি বাংলা মাস! বাট, উসমে কেয়া হ্যায়! গুগল হ্যায় ইয়ার! স্মার্টফোনে সার্চ দিলেই হাতের মুঠোয় ‘বাংলা’! বাংলা সাল, তার ৩৬৫টি তারিখ, তার বারোটি মাস! বারো মাস তো পেলাম, কিন্তু ‘তেরো পার্বণ’? ব্যস, গুগল গন! বাঙালির মুখ ফ্যাকাসে, ‘ইভেন গুগল ডাজ নট নো দ্যাট’! ঘেমেটেমে, হাতের কর গুনে, কিছুতেই আর ১৩ মেলানো যায় না। খালি বেশি হয়ে যায়, বড় বেশি হয়ে যায়। কী রাখি আর কী যে ছাড়ি। ইজ দেয়ার এনি ইউনিভার্সাল রুল টু কাউন্ট পার্বণ?

আরে বাবা, ‘তেরো পার্বণ’ তো কোনও সংখ্যা বোঝায় না, ওটা একটা চরিত্রকে বোঝায়। একটা প্লুরালিটি, উৎসবের বহুবচন! ঠিক যেমন পয়লা বৈশাখ শুধু একটা দিন নয়, একটা ‘ধারণা’, একটা সংস্কৃতি, একটা সত্তা! গুগল এ সব জানবে কী করে! অবশ্য গুগলের আর কী দোষ। বাঙালি নিজেই তো ভুলে গেছে যে, তাদের আপনঘরে গুগলেরও গুরু আছে! তিনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় একশো বছর আগে, শান্তিনিকেতনে বসে, জনৈক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্দেশে তিনি একাই ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বই হল ৫০ হাজার বাংলা শব্দের সমাহার, অর্থ টীকা ব্যাখ্যা উৎপত্তি-সহ। ওটাই ‘একক উদ্যোগে বিশ্বের বৃহত্তম অভিধান’। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রায়শই ওই শব্দকোষ থেকে বাংলা শব্দ সংগ্রহ করে নিজেদের ডিকশনারিতে জুড়ে দেয়। আর তাদের ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’-এ হিরের টুকরোর মতো জ্বলজ্বল করে হরিচরণের নাম। বিদেশিরা জানে এ সব, কিন্তু প্রশ্ন, ক’জন বাঙালি জানে এই ‘ইনফো’! ইনফো, এখন ইতিহাসকে আমরা এই নামেই ডাকি। কত অজানা রে!

এমন কিছু অজানাই বাঙালিকে এখন বিশ্বমাঝারে রিক্ত সর্বস্বান্ত একলাটি করে দিচ্ছে। কারণ, চরিত্র গেলে সবই চলে যায়! পয়লা বৈশাখও হয়ে যায় এক একলাপনার উৎসব। হারিয়ে যায় ছয় ঋতু, বারোমাস, তেরো পার্বণের সালতামামি। বড় হলে যেমন হারিয়ে যায় মায়ের রান্না, বাবার কোল! মা যত দিন ছিল, পয়লা বৈশাখ সকালে আমাকে নিয়ম করে বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা কিনতে হত, সঙ্গে অবশ্যই একটা বাংলা বর্ষপঞ্জি। এখন তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমার মা আর নেই। বাংলা বছরের প্রথম দিনটা এখন আমার কাছে সর্বার্থেই একলা বৈশাখ! ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড’!

অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

Poila Baisakh Special Bengali Festival Bengali Culture পয়লা বৈশাখ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy