Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

আর্সেনিকের বিষ এড়াচ্ছে বিনিময় পাড়া

একটা সময় ছিল, জল মুখে তুলতে বুক কাঁপত অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিনিময় পাড়ার বাসিন্দাদের। আর্সেনিক মেশানো জল খেয়ে ওই এলাকার বহু মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন আগে। বুধবারও প্রৌঢ়া করুণা দাস মারা গিয়েছেন। তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। আর্সেনিক আক্রান্তও ছিলেন। কিন্তু ইদানীং নতুন করে আর্সেনিকের দূষণ ছড়াচ্ছে না কারও মধ্যে।

প্রকল্প দেখছেন প্রতিনিধিরা। নিজস্ব চিত্র।

প্রকল্প দেখছেন প্রতিনিধিরা। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
অশোকনগর শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:৫৮
Share: Save:

একটা সময় ছিল, জল মুখে তুলতে বুক কাঁপত অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিনিময় পাড়ার বাসিন্দাদের। আর্সেনিক মেশানো জল খেয়ে ওই এলাকার বহু মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন আগে। বুধবারও প্রৌঢ়া করুণা দাস মারা গিয়েছেন। তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। আর্সেনিক আক্রান্তও ছিলেন। কিন্তু ইদানীং নতুন করে আর্সেনিকের দূষণ ছড়াচ্ছে না কারও মধ্যে।

মাসখানেক আগে এলাকায় আর্সেনিক রোগী চিহ্নিত করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা ক্যাম্প করেছিলেন। সেখানেই দেখা গিয়েছে, নতুন করে আর আর্সেনিকে আক্রান্ত হননি এলাকার কেউ। সে দিন যাদের শরীরে আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছিল, তাঁদের বহু বছর আগে থেকেই ওই সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

কী ভাবে সম্ভব হল আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ?

বছর পঁয়ত্রিশ আগে ওই এলাকা থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষ এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যেতেন। সে সময়ে সেখানকার চিকিৎসক ছিলেন কে সি সাহা। চর্ম বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসকের একই এলাকা থেকে একই রকম রোগের লক্ষণ দেখে মনে হয়েছিল, পানীয় জল থেকেই ছড়াচ্ছেআর্সেনিকের দূষণ। যার জেরে বাড়ছে ক্যান্সার আক্রান্তের হার। ওই চিকিৎসক এলাকার পানীয় জল পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন স্থানীয় চিকিৎসক সাধন সেন। এলাকার জল পরীক্ষা করে ওই চিকিৎসক জানান, পানীয় জলে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক রয়েছে। ওই জল খাওয়ার ফলেই ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

সময়টা ১৯৮০-৮১ সাল হবে। এলাকার মানুষ সে ভাবেই প্রথম জানতে পারেন আর্সেনিকের দূষণের কথা। বিপদের কথা ববুঝতে পেরে টিউবয়েলের জ‌ল খাওয়া বন্ধ করেন বাসিন্দারা। সরকারও নড়েচড়ে বসে। এলাকায় চারটি ৪০০ ফুটের গভীর নলকূপ বসানো হয়। সাধারণ মানুষ ওই নলকূপের জল খেতে শুরু করেন।

কিন্তু বছর পঁচিশ আগে ওই গভীর নলকূপের জল পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাতেও মিশে রয়েছে উচ্চমাত্রায় আর্সেনিক। বিনিময় পাড়ার কাছেই অশোকনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের নিজস্ব গভীর নলকূপের জলেও আর্সেনিকের বিষাক্ত উপস্থিতি পাওয়া পাওয়া যায়। পরবর্তী দিন দশেক হাসপাতালে রোগী ভর্তি পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

বিনিময় পাড়ার গভীর নলকূপে আর্সেনিক মেলায় হাবরা, নৈহাটি, ভাটপাড়া প্রভূতি পুরসভা এলাকা থেকে গাড়ি করে ট্যাঙ্কে জল নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে সরকার। পরবর্তী সময়ে অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভা জলের নিজস্ব গাড়ি কেনে। বিনিময় পাড়ার মানুষকে পানীয় জল সরবরাহ শুরু হয়। সেটা ২০০৫ সাল পর্যন্ত।

আতঙ্কিত এলাকার মানুষ বিকল্প আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের সন্ধানে তোড়জোড় শুরু করেন। এলাকার মানুষ একত্রিত হয়ে তৈরি করেন ‘বিনিময় পাড়া অমল আর্সেনিক সমিতি’। ২৬ জনের কমিটির সম্পাদক হন স্বপন পাল ওরফে টেক্কা। তিনি নিজেও আর্সেনিক আক্রান্ত। টেক্কাবাবু বলেন, ‘‘কমিটি তৈরি করে আমরা শিবপুর বিই কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ২০০৫ সালে ওই কলেজের সহযোগিতায় এলাকায় আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের ফ্লিটার প্রকল্প শুরু হয়। তারপর থেকেই এলাকার মানুষ আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল খেয়ে আসছেন ওই প্রকল্প থেকে। নতুন করে এলাকার কেউ আর আর্সেনিকে আক্রান্ত হননি।’’

প্ল্যান্টের গিয়ে দেখা গেল, সেখানে আর্সেনিকের ফলে ক্যন্সারে মৃত মানুষের নামের তালিকা টাঙানো আছে। সেখান থেকেই জানা গেল, ১৯৮০-২০০৯ পর্যন্ত সেই সংখ্যাটা ২৪। যদিও সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে বলেই কমিটির দাবি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, ওই প্রকল্প চালু করতে কমিটির লোকজনের রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। যে দিন প্ল্যান্টটি বসানো হচ্ছিল, সে দিনও রাজনৈতিক মদতে কমিটির লোকজনকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। প্ল্যান্ট বসানোর সাত দিনের মধ্যে সেটি ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু এলাকারই কিছু রাজনৈতিক মানুষের হস্তক্ষেপে পরবর্তী সময়ে সমস্যা মেটে।

পরবর্তী সময়ে ‘টেকনোলজি উইথ এ হিউম্যান ফেস’ নামে একটি সংস্থা ওই প্রকল্প চালানোর দায়িত্ব নেয়। এখনও সহযোগিতা করে আসছে তারা। বুধবার প্রতিনিধিরা এলাকায় প্রকল্পের কাজ কেমন চলছে, তা সরেজমিনে দেখতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন জাপানের এক প্রতিনিধিও। এ ছাড়া, এমআইটি-র পড়ুয়ারাও এসেছিলেন আমেরিকা থেকে। তাঁরা প্রকল্পের কাজ সম্পর্কে খুঁটিনাটি খোঁজ-খবর করেন। এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন।

সংস্থার প্রতিনিধি প্রসূন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমরা মাঝে মধ্যেই এখানে এসে প্রকল্পের কাজ কেমন চলছে তা দেখে যাই। প্ল্যান্টের জল প্রতি মাসে একবার করে নিয়ে গিয়ে আমাদের নিজস্ব ল্যাব বা অন্য সংস্থার ল্যাব থেকেও পরীক্ষা করি। দেখা হয়, জলে আর্সেনিকের মাত্রা কেমন রয়েছে। আর্সেনিক সমস্যা থেকে এখানকার মানুষ মুক্ত হয়েছেন জেনে ভাল লাগছে।’’

প্ল্যান্টে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের মানুষ জল নিচ্ছেন সেখান থেকে। তাঁদেরই একজন প্রৌঢ়া সন্ধ্যা ঘোষ জানালেন, স্বামী বছর দ’শেক আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। তিনি আর্সেনিকে আক্রান্ত ছিলেন। সন্ধ্যাদেবীর কথায়, ‘‘আমরা তো বাড়ির টিউবয়েলের জল খেতাম। প্রথমে আর্সেনিক সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। যখন স্বামীর ক্যান্সার ধরা পড়ল, তখনই সব জানতে পারলাম। এখন আমরা প্ল্যান্টের জল খাই। আমাদের আর্সেনিক সমস্যাও মিটে গিয়েছে।’’ কাঞ্জন দাস নামে এক বৃদ্ধার স্বামী নিমাইবাবুও শরীরে আর্সেনিক দূষণের ফলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। তিনিও এখন প্ল্যান্টের জল খাচ্ছেন। টেক্কাবাবু বলেন, ‘‘ বিনিময় পাড়ায় আড়াইশো পরিবারের বাস। তার মধ্যে ২০০টি পরিবার প্ল্যান্টের পানীয় জল খান। প্রতিদিন একটি পরিবারকে ২০ লিটার করে জল দেওয়া হয়। সে জন্য মাসে নেওয়া হয় ৩০ টাকা।’’ প্ল্যান্টটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্যেই ওই টাকা নেওয়া হয় বলে জানালেন তিনি।

কিন্তু এই মডেল অন্যত্র চালু হচ্ছে না কেন?

প্রসূনবাবু জানান, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও বিহারে এ ধরনের প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে আরও জোরদার বিপণন দরকার বলে মনে করেন তিনি। প্রজেক্টের খরচ ৫ লক্ষ টাকা। এই টাকার অর্ধেক দেওয়ার কথা যাঁরা প্রকল্প চান, তাঁদের। বাকি টাকা দেবে সংস্থা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE