Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কিশোরীর মৃত্যু, লেভেল ক্রসিংয়ের দাবি

গাইঘাটা থানার ঠাকুরনগর এলাকার রেললাইনের এক পাড়ে পাতলাপাড়া, অন্য পাড়ে চিকনপাড়া। মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে রেলের ডবল লাইন।

এই লাইন পেরোতে গিয়েই যত বিপত্তি। ইনসেটে, লক্ষ্মী বালি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

এই লাইন পেরোতে গিয়েই যত বিপত্তি। ইনসেটে, লক্ষ্মী বালি। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
গাইঘাটা শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:১৪
Share: Save:

গাইঘাটা থানার ঠাকুরনগর এলাকার রেললাইনের এক পাড়ে পাতলাপাড়া, অন্য পাড়ে চিকনপাড়া। মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে রেলের ডবল লাইন। অজস্র ট্রেন রোজ যাতায়াত করে। অরক্ষিত, লেভেল ক্রসিংহীন ওই এলাকা দিয়েই প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ চলাফেরা করেন। একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে আগে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের বহু আন্দোলনের পরেও লেভেল ক্রসিংয়ের দাবি পূরণ হয়নি।

মঙ্গলবার সকালেও ওই এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গিয়েছে স্থানীয় শিমুলপুর এলাকার বাসিন্দা লক্ষ্মী বালি (১৬)। আরও একটি প্রাণের বিনিময়ে নতুন করে জোরদার হয়েছে লেভেল ক্রসিংয়ের দাবি।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বারই মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল লক্ষ্মীর। সবুজ সাথী প্রকল্পে পাওয়া সাইকেল নিয়ে বাজারে এসেছিল সে। সকাল পৌনে ১২টা নাগাদ রেললাইন পেরিয়ে চিকনপাড়ার দিক থেকে পাতলাপাড়ার দিকে যাচ্ছিল মেয়েটি। তার সামনে দিয়ে বনগাঁ থেকে শিয়ালদহগামী একটি ট্রেন বেরিয়ে যায়। ওই ট্রেনটি চলে যেতেই সাইকেল নিয়ে লাইনে উঠে পড়ে লক্ষ্মী। কিন্তু ওই সময়েই শিয়ালদহের দিক থেকে বনগাঁর দিকে আপ ট্রেনটি চলে আসে। ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় ওই কিশোরী।

লক্ষ্মীর মৃত্যুতে ক্ষোভ বে়ড়েছে এলাকায়। গ্রামবাসীরা জানালেন, বছরখানেক আগে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছিল পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর। ঘটনার প্রতিবাদে ও এলাকায় একটি লেভেল ক্রসিংয়ের দাবিতে সে বার রেল অবরোধ করেছিলেন স্থানীয় মানুষজন। স্মারকলিপিও জমা দেওয়া হয়েছিল রেলের কাছে। রেল কর্তৃপক্ষের তরফে প্রতিশ্রুতি মিলেছিল বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার করে দেখার। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও আজও দাবি মেটেনি। উল্টে ফের ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ গেল এক ছাত্রীর।

ভরতচন্দ্র অধিকারী নামে এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘ঠাকুরনগর স্টেশনের দিক থেকে ট্রেন এলে দূর থেকে বোঝাই যায় না। বছরখানেক আগে ওই ছাত্রীর মৃত্যুর পরে আমরা লেভেল ক্রসিংয়ের দাবিতে রেল অবরোধ করেছিলাম। উল্টে রেল কর্তৃপক্ষ আমাদের নামে মামলা করে দেয়। সে কারণে এ বার আর অবরোধ হয়নি। কিন্তু এলাকার মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছেন।’’ হতাশাও দানা বেঁধেছে। এলাকার কয়েকজন প্রবীণ বাসিন্দা বললেন, ‘‘একটু লিখে দেবেন, রেলের উদাসীনতার জন্যই আমাদের প্রাণ আজ সুরক্ষিত নয়। কী করলে ওদের কানে জলে ঢুকবে বলতে পারেন!’’

বনগাঁ-শিয়ালদহ শাখার ঠাকুরনগর ও চাঁদপাড়া রেলস্টেশনের মাঝে পাতলাপাড়া। ঠাকুরনগর স্টেশন থেকে যা প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। ওই এলাকায় রেললাইনের মধ্যে প্রায় তিন কিলোমিটার অংশে কোনও লেভেল ক্রসিং নেই। আছে স্থানীয় গাঁতি এলাকায়। অরক্ষিত রেললাইন পেরিয়ে পাতলাপাড়া ছাড়াও খড়ের মাঠ, দিঘা, উত্তর শিমূলপুর, চৌরঙ্গী, নওদা-সহ বহু গ্রামের মানুষকে রোজ যাতায়াত করতে হয়। স্কুল পড়ুয়া, বা সাধারণ মানুষকে নানা প্রয়োজনে রেললাইন পেরিয়ে চিকনপাড়ার দিকে আসতেই হয়। কারণ, এ দিকেই রয়েছে ছেলেমেয়েদের দু’টি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কলেজ, বাজার, ব্যাঙ্ক। ঠাকুরনগর বাজারে বসে ফুলের বাজার। পাতলাপাড়া-সহ রেললাইনের ওই অংশে বসবাস করা বহু মহিলা-পুরুষ ফুলের ব্যবসায় যুক্ত। তাঁদের রেললাইন পেরিয়ে আসতে হয়।

তাঁদেরই একজন সুখদা সিকদার ভ্যানে ফুল চাপিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। বললেন, ‘‘লাইনে উঠলেই বুক দুরুদুরু করে। এই বুঝি ট্রেন এসে পড়ল।’’ টিঙ্কু পাণ্ডে নামে গোবরডাঙা হিন্দু কলেজের প্রথম বর্ষের এক কলেজ ছাত্রী বলছিলেন, ‘‘আমিও সাইকেল নিয়ে রেললাইন পেরিয়ে যাতায়াত করি। লক্ষ্মীর মৃ্ত্যুর পরে লাইন পেরোতে ভয় হচ্ছে।’’

চূড়ামণি দে, গৌরাঙ্গ হালদার নামে দুই প্রৌঢ়ের কথায়, ‘‘দিনের বেলায় যেমন-তেমন চলে যায়। কিন্তু রাতে খুবই অসুবিধা হয় লাইন পেরোতে। ভয় ভয় করে। আর শীতের সময়ে কুয়াশায় তো দূরের কিছু দেখাই যায় না। এ ভাবে আর কত প্রাণের বিনিময়ে অবস্থার পরিবর্তন হবে কে জানে!’’

পাতলাপাড়ার কিছুটা দূরে তারকস্মরণী এলাকাতেও মানুষ রেললাইনের উপর দিয়ে অরক্ষিত ভাবে যাতায়াত করেন। এখানকার মানুষেরও লেভেল ক্রসিংয়ের দাবি আছে।

কী বলছে রেল কর্তৃপক্ষ?

তাদের দাবি, শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখায় ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যুর ঘটনা নিয়মিত ঘটছে, এটা সত্যি। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মানুষের সচেতনারও অভাব রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, মোবাইল কানে নিয়ে মানুষ রেললাইনে ধরে যাতায়াত করছেন। ট্রেন আসছে কিনা সে সম্পর্কে সজাগ থাকছেন না। তবে পাতলাপাড়ার বিষয়ে পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘লেভেল ক্রসিংয়ের দাবি বিস্তারিত ভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা হবে।’’

কয়েক বছর আগে লক্ষ্মীর বাবা ভোলাবাবুও ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গিয়েছিলেন। তবে জায়গাটা অবশ্য অন্যত্র ছিল। দরিদ্র পরিবারে রঙের কাজ করে ক্লাস এইটে পড়া ছেলে আর মেয়ে লক্ষ্মীকে নিয়ে সংসার ছিল মা মাধুরীর। মেয়েকে হারিয়ে শোকে পাথর মহিলা। শুধু বললেন, ‘‘লেভেল ক্রসিংটা না হলে এমন আরও অনেক মায়ের বুক খালি হয়ে যাবে।’’

সে কথা রেল কর্তৃপক্ষ বুঝলে তো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE