সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে কয়েকদিন ধরেই চলছে অপপ্রচার। এলাকায় নাকি ঢুকে পড়েছে দুষ্কৃতীরা! তাদের কেউ পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে কাউকে একা পেলেই ধরে নিয়ে গিয়ে কিডনি বের করে নিচ্ছে! আবার কেউ নাকি ধরে নিয়ে যাচ্ছে শিশুদের!
সোশ্যাল মিডিয়ার এই সব প্রচারে প্রভাবিত হয়ে গত কয়েক দিনে উত্তাল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন জায়গা। অচেনা ব্যক্তি দেখলেই সন্দেহবশে তাঁকে মারধর করতে শুরু করে দিচ্ছে অনেকে। রবিবার মগরাহাট এলাকায় সন্দেহের বশে দু’জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। চোর বা কিডনি পাচারকারী সন্দেহে একের পর এক গণপিটুনির খবর আসতে শুরু করেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। মগরাহাটেই একাধিক ঘটনা ঘটেছে। জয়নগরের বহড়ু স্টেশন চত্বরে দু’জন অজ্ঞাতপরিচয়কে বেধড়ক মারধর করা হয়। একই ঘটনা ঘটে বেলিয়াচণ্ডী, মোমরেজগড়ে।
তবে, শুধু গুজব ছড়িয়ে নিরাপরাধ লোকদের মারধরই নয়, হামলা-লুটপাটও করা হচ্ছে এলাকার দোকানপাটে। ডায়মন্ড হারাবার জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, গণপিটুনির পর এক দল গিয়ে দোকানপাট ভাঙচুর ও লুটপাট করছে। জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, ‘‘কোনও একটি শক্তি এলাকায় উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য এমন কাজ করছে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিকল্পনা করেই এই ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কারা এই কাজ করছে তা খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ ও প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’
পর পর ঘটনার জেরে মাঠে নেমেছে পুলিশ। মাইক নিয়ে এলাকায় এলাকায় প্রচার শুরু হয়েছে। বিলোনো হচ্ছে লিফলেটও। পুলিশ সূত্রের খবর, এই ধরনের খবরের কোনও ভিত্তি নেই। পুরোটাই গুজব। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সব প্রচার দেখে বা লোকমুখে শুনে আতঙ্কিত ও উত্তেজিত হয়ে উঠছেন মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছেন এলাকায় এলাকায় ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরেরা। রবিবার বিভিন্ন এলাকা থেকে জনতার হাতে প্রহৃত সাত জনকে উদ্ধার করে জয়নগর থানার পুলিশ। তাঁদের বেশিরভাগই ভবঘুরে এবং মানসিক ভারসাম্যহীন বলেই জানিয়েছে পুলিশ। এঁদের মধ্যে এক জন ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দাও রয়েছেন। তিনিও মানসিক ভারসাম্যহীন। রবিবার বহড়ু স্টেশন চত্বরে এক জনকে ধরে শিশুচোর সন্দেহে মারধর করে জনতা। পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে। পরে জানা যায়, গড়িয়ায় থাকেন ওই ব্যক্তি। মাঝেমধ্যেই ট্রেনে চড়ে বিভিন্ন নির্জন স্টেশনে গিয়ে বসে থাকেন। কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরে আসেন। সে ভাবেই বহড়ুতে এসে বসেছিলেন তিনি।
বারুইপুর জেলা পুলিশের সুপার অজয়প্রসাদ জানান, গোটা বিষয়ের তদন্ত চলছে। পাশাপাশি, এ ধরনের গুজবে কান না-দেওয়ার জন্য প্রচার চালাচ্ছে পুলিশ। অটো, টোটো করে এলাকা এলাকায় ঘুরে মাইকে প্রচার করা হচ্ছে। প্রতিটি পঞ্চায়েত, অঞ্চলকে সতর্ক করা হয়েছে। পঞ্চায়েতের তরফেও গ্রামে গ্রামে প্রচার চলছে। ব্লক স্তর থেকেও প্রচারে নামা হয়েছে। সোমবার কুলতলির জামতলা এলাকা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানোর অপরাধে এক জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, নুর ইসলাম শেখ নামে বছর ত্রিশের ওই যুবক দু’জন ব্যক্তিকে দেখিয়ে কিডনি পাচারকারী বলে এলাকাবাসীকে উত্তেজিত করছিল। খবর পেয়ে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
প্রচারে কাজ হচ্ছে বলেই দাবি পুলিশের। সোমবার সকালে পুলিশের কাছে খবর আসে, জয়নগরে একটি বাচ্চা ছেলে সমেত একজন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে দেখা গিয়েছে। পুলিশ এসে ওই ব্যক্তিকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তির বাড়ি মগরাহাটে। মানসিক ভাবে তিনি কিছুটা ভারসাম্যহীন। ছেলেকে নিয়ে এ দিন সরবেড়িয়ায় কালীমন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলেন। বাড়ির লোককে ডেকে তাঁদের হাতে তাঁকে তুলে দেয় পুলিশ। পুলিশ জানায়, প্রচারের জন্যই মারধর না করে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেয় জনতা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, মুলত ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার মগরাহাট, ফলতা, ডায়মন্ড হারবার, বিষ্ণুপুর, নোদাখালি, রবীন্দ্রনগর, উস্তি থানা এলাকায় গুজব ছড়ানোর অভিযোগ বেশি। ওই সব এলাকায় কয়েক মাস ধরেই গুজব ছড়ানো হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে ফলতা থানা এলাকায় চোর সন্দেহে একজনকে মারধর করা হয়েছিল। শুধু ফলতা নয়, গত কয়েক মাসে চোর সন্দেহে বিভিন্ন থানায় এলাকায় পাঁচ জনকে মারধর করা হয়েছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ। ওই সব ঘটনায় কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের জেরাও করা হয়েছে। ডায়মন্ড হারবার জেলা পুলিশের এক কর্তার কথায়, ‘‘ধৃতদের জেরায় উঠে আসা তথ্যের উপরই এখন পরিস্থিতির পিছনের কারা দায়ী, তা শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ জেলাশাসক বলেন, ‘‘শুধু পুলিশ নয়। জেলা প্রশাসনের তরফে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৩১০টি পঞ্চায়েতের প্রধান-সহ সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একে বারে বুথস্তর থেকে ওই ঘটনা প্রতিরোধের পরিকল্পনা করা হয়েছে। একদিকে পঞ্চায়েত স্তর, অন্যদিকে থানাভিত্তিক সিভিক ভলান্টিয়ারদেরও গুজব প্রতিরোধে সক্রিয় করা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy