লকডাউনের মধ্যেই রাস্তায় ঘুরলেন কিছু মানুষ (হাসনাবাদ, বাঁ দিকে)। (ডান দিকে) কিছু যুবক মাস্ক বিতরণ করছিলেন। তা নেওয়ার জন্য ভিড় করেছেন মানুষ। জয়নগরে। ছবি: নির্মল বসু ও সুমন সাহা
লকডাউন কি উঠে গিয়েছে?
সোমবার দুই জেলার নানা প্রান্তে দোকান-বাজারে ভিড়ভাট্টা দেখে অনেকেরই চোখ কপালে। ভাঙড়, কাকদ্বীপ থেকে কাঁচরাপাড়া— সর্বত্রই একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় রাস্তায় রীতিমতো জনজোয়ার। কে বলবে লকডাউন চলছে! অটো-টোটোর দাপটও চোখে পড়ল। মাঠে ফুটবলও পেটাল ছেলের দল। চায়ের দোকানে করোনা-আলোচনায় আসর গরম করলেন অনেকে।
পরিস্থিতি সামলাতে যাঁরা পারতেন, সেই পুলিশ কর্মীরা বেশির ভাগ সময়ে সমাজসেবায় ব্যস্ত থাকলেন। কোথাও পথ-কুকুরদের দেখভাল করছেন, তো কোথাও ভবঘুরেদের হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন। কিন্তু ঘরবন্দি হয়ে না থাকলে লকডাউনের উদ্দেশ্য যে বিফলে যাবে, সে খেয়াল নাগরিকদের একাংশের নেই। পুলিশকে সে দিকে নজর দিতে এ দিন কমই দেখা গিয়েছে। শুরুর দিকে অবশ্য পুলিশের অতিসক্রিয়তা নিয়েও অভিযোগ উঠেছিল। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক কর্তা জানালেন, নানা নানা চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে তাঁদেরও। পুলিশের আর একটি সূত্রের খবর, উপর মহল থেকে তাঁদের ‘বাড়াবাড়ি’ না করার নির্দেশ এসেছে।
বনগাঁ পথে সোমবার সকালে দেখা গেল, যাত্রী নিয়ে চলছে অটো-ভ্যান-টোটো। বড় যানবাহনও চলছে। মানুষজন বাইক-সাইকেল নিয়ে পথে নেমে পড়েছেন। যা দেখে সচেতন নাগরিকেরা অনেকেই আতঙ্কিত। কার্যত, এ দিন সকালে বনগাঁ শহরের রাস্তায় বেরিয়ে বোঝার উপায় ছিল না, দেশ জুড়ে লকডাউন চলছে। বহু চা-পান-সিগারেটের দোকান খোলা ছিল। যশোর রোডের ধারে চায়ের দোকানে এক বৃদ্ধের কাছে জানতে চাওয়া হল, কেন বেরিয়েছেন? জানালেন, ওষুধ কিনতে। যদিও ব্যাগে দেখা গেল, রয়েছে কলার কাঁদি! প্রেসক্রিপশনও দেখাতে পারলেন না। এক বাইকে তিন যুবক যাচ্ছিলেন। পুলিশ বাইক থামাতে জবাব মিলল, ওষুধ কিনতে বেরিয়েছেন। কিন্তু তিনজন কেন? কোনও উত্তর নেই। পুলিশও সাবধান করার বাইরে কিছু করেনি।
গত কয়েক দিন ধরে নিউ মার্কেট এলাকায় যথেষ্ট ভিড় হচ্ছিল। এ দিন সেই ভিড় ছিল অনেক বেশি। দেখা গেল, অনেকেই চা খেতে বেরিয়েছেন। সঙ্গে পুরনো কোনও প্রেসক্রিপশন। শহরের এক স্কুল শিক্ষকের কথায়, “বিষয়টা যেন, কী ভাবে পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া যাবে। কিন্তু নিজের বিপদটা মানুষ বুঝতে পারছেন না।” শহরে মদ-জুয়ার আসর বসছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে পুলিশ করছে কী? এক পুলিশ কর্তার বক্তব্য, “সোমবার সকালে নিজেরাই রাস্তায় বেরিয়ে লজ্জা পেয়েছি। ধরপাকড় করা যাচ্ছে না। লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গেলেও পরে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। বুঝিয়েও অনেক সময়ে লাভ হচ্ছে না।”
কাঁচরাপাড়া, হালিশহর, কাঁকিনাড়া, ভাটপাড়াতেও দেখা গেল একই ছবি। চটকল বন্ধ। কিন্তু শ্রমিক বস্তির রাস্তায় জনজোয়ার। গত কয়েক দিন বন্ধ থাকলেও এ দিন দোকানপাট খোলাই ছিল। পুলিশ টহল দিয়েছে। সতর্ক করেই আবার চলে গিয়েছে। লকডাউনের শুরুতে পুলিশকে লাঠি চালাতে দেখে বাড়ির ছাদে হাততালি পড়েছিল এই এলাকাতেই। তাঁরা বলছেন, “পুলিশ তখন একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেছিল। বিষয়টা বুঝিয়ে বললেই ভাল।’’ বসিরহাটে পুলিশের সক্রিয়তায় অকারণে রাস্তায় বের হওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বাজারে হানা দেওয়ায় বন্ধ হয়েছিল কালোবাজারিও। এমনকী, দাম বেশি নেওয়ায় সিল করে দেওয়া হয়েছিল মুরগি খামার। পাকড়াও করা হয়েছিল চালের কারবারিকে। তারপরেই ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে উপর মহলে অভিযোগ দায়ের করেন বলে জানা যাচ্ছে। পুলিশ সূত্রের খবর, দুই পুলিশ কর্মীর উপরে শাস্তির খাঁড়াও নেমে আসে। ক্ষুব্ধ পুলিশ কর্মীরা তারপর থেকে সচেতনতা কর্মসূচির উপরেই জোর দিচ্ছেন। এই পরিসথিতিতে পুলিশের নাকের ডগায় রাস্তায় চলছে মোটরবাইক রেস। বাজারেও সেই আগের ভিড় ফিরতে শুরু করেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ডিউটি করছেন সিভিক ভলান্টিয়ার। হেমনগর, সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ,ন্যাজাট থানা এলাকার বিভিন্ন বাজারে সকালের দিকে ভিড় আগের থেকে অনেক বেড়ে গিয়েছে। দোকানের সামনে নির্দিষ্ট দূরত্বে গণ্ডি থাকলেও কেউ তোয়াক্কা করছেন না বলে দেখা গেল।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ছবিটাও অনেক ক্ষেত্রে একই রকম। পাড়ার মোড়ে মোড়ে মানুষের জটলা। মাঠে চলছে ক্রিকেট-ফুটবলের আসর। চায়ের দোকানে তাসের আড্ডা বসেছে। রবিবার সন্ধ্যায় কাশীপুর থানার ওসি বিশ্বজিৎ ঘোষ বাহিনী নিয়ে এলাকায় টহল দেন। ছিলেন ভাঙড় ২ বিডিও কৌশিককুমার মাইতিও। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। তবে তাতে কাজের কাজ হয়নি। রাস্তায় যতক্ষণ পুলিশ থাকছে, ততক্ষণ সাধারণ মানুষ ঘরবন্দি থাকছেন। পুলিশ সরে যেতেই ফিরে আসছে জমায়েতের চেনা ছবি। সোমবার সকালে ভাঙড় বিজয়গঞ্জ বাজার-সহ আশপাশের বিভিন্ন বাজারেও মানুষের ভিড় উপচে পড়ে।
ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ মহকুমার বিভিন্ন হাটে-বাজারে ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। দোকানপাটও একে একে খুলতে শুরু করেছে। সকাল ৬টা থেকে প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক ভিড় ছিল বিভিন্ন এলাকায়। পরে ভিড়টা কমে। এত মানুষের একসঙ্গে রাস্তায় বেরোনোয় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। তাঁদের কেউ কেউ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কাছে অভিযোগও জানিয়েছেন। জয়নগরের দক্ষিণ বারাসত বাজারেও রোজ সকালে কেনাকাটা করতে ভিড় করছিলেন মানুষ। সঙ্কীর্ণ জায়গা হওয়ায় বাধ্য হয়ে ঘেষাঘেষি দাঁড়িয়েই কেনাকাটা করতে হচ্ছিল। প্রশাসনের তরফে তাই বাজারটি সরিয়ে স্থানীয় একটি ফাঁকা মাঠে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy