Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ঘুরে দাঁড়াচ্ছে জামতলা, জমতে দিচ্ছে না মৌতাত

এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, ইদানীং আর বাইরের লোক তেমন চোখে পড়ে না। স্থানীয় যুবকেরা আড়াল-আবডাল খোঁজে।

নেশার-টানে: কয়েক বছর আগেও দিনে-রাতে দেখা যেত এই দৃশ্য। ফাইল চিত্র

নেশার-টানে: কয়েক বছর আগেও দিনে-রাতে দেখা যেত এই দৃশ্য। ফাইল চিত্র

সীমান্ত মৈত্র
শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৮ ০২:০৩
Share: Save:

পলিথিনে মোড়া পুরিয়ার দাম এক একটা ১৫০-৩৫০ টাকা। ‘গুণগত’ মানের ভিত্তিতে দাম ওঠা-নামা করে। একটি রাংতার কাগজ নৌকার মতো ভাঁজ করে তাতে হেরোইন ঢেলে শুরু হয় সুখটান দেওয়া। কেউ কেউ আবার সিগারেটের মধ্যে ঢেলেও নেশা করে। বহিরাগত ও স্থানীয় নেশাড়ুদের মৌতাত জমত বনগাঁর জামতলায়।

এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, ইদানীং আর বাইরের লোক তেমন চোখে পড়ে না। স্থানীয় যুবকেরা আড়াল-আবডাল খোঁজে। কিন্তু কিছু দিন আগে পর্যন্তও স্থানীয় জামতলা এলাকায় সকাল-সন্ধ্যায় জমে উঠত হেরোইনের মৌতাত। বনগাঁ স্টেশন বা মতিগঞ্জে পৌঁছে জামতলার খোঁজ করলেই ভ্যান চালক আগন্তুকদের নিয়ে যেতেন জামতলায় নেশার আখড়ায়। কেউ পুরিয়া কিনে ফিরতি ভ্যানে চাপতেন। কেউ আবার আসরে বসে পড়তেন।

তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের ছাত্র, বয়স্ক মানুষ— সকলেই ভিড় জমাতেন। যে সব পড়ুয়াদের বনগাঁ থেকে কলকাতার কলেজে যেতেন, তাঁদের উপর দায়িত্ব পড়ত, বন্ধুদের জন্য হেরোইন জোগাড়ের। ইদানীং সেই প্রবণতাও কমছে বলে জানালেন অনেকে। তবে চোরাগোপ্তা বিক্রিবাট্টা এখনও চলে বলে জানালেন কেউ কেউ।

নেশার কবলে পড়ে শেষ হওয়া পরিবারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

খলিতপুর গ্রামে থাকতেন রতন মণ্ডল। তাঁর ন’ছেলের মধ্যে চারজনই হেরোইনের নেশায় মারা গিয়েছে বহু কাল হল। সন্তান-বিয়োগের যন্ত্রণায় মারা যান বাবা-মা। রতনবাবুর বৌমা রত্না মণ্ডল বললেন, ‘‘বিয়ে হয়ে আসার পরে দেখলাম, পরিবারে নেশা করে একে একে চারজন মারা গেলেন। বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকত। সে সব দিন আর মনে করতে চাই না।’’

নেশা থেকে মুখ ফেরানোর গল্পও আছে। এক সময়ে স্বামী নেশা করতেন। নানা ভাবে লড়াই করে সেখান থেকে স্বামীকে সুস্থ জীবনে ফেরাতে পেরেছিলেন এক মহিলা। তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিদিন বাড়ি ফিরে মারধর করতেন স্বামী। ছেলেমেয়েরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। বাড়ির সব কিছু বিক্রি করে দিতেন উনি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি অনেক ঠিকঠাক।’’

বছর দশেক আগেও হেরোইনের রমরমা কারবার ছিল এলাকায়। বহু পরিবার এর জেরে সর্বস্বান্ত হয়েছে। বাড়ির ছেলেরা নেশায় আসক্ত হয়ে স্ত্রী-বাবা-মাকে মারধর করে, ঘরের জিনিসপত্র চুরি করে বিক্রি করে নেশার টাকা সংগ্রহ করত। স্ত্রীর সোনার গয়না পর্যন্ত চুরি করে বিক্রি করে নেশা করেছে স্বামী, এমন উদাহরণ তো আকছার শোনা যেত। কয়েক বছর আগে বনগাঁ থানা এলাকায় সাইকেল চুরির ধুম পড়ে গিয়েছিল। হেরোইন আসক্তরাই মূলত সাইকেলগুলি চুরি করত বলে জানতে পারে পুলিশ।

নেশার কবল থেকে অবশ্য ধীরে বেরিয়ে আসছে এলাকা। এক প্রৌঢ়ার কথায়, ‘‘একটা সময় ছিল, এলাকার দুর্নাম এমন ছড়িয়েছিল, এই গ্রামে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইত না বাইরের পরিবার।’’ ২০০৫ সাল নাগাদই কয়েকজন নেশাড়ু নিজেদের তাগিদে নেশা ছাড়েন। তাঁরা অন্যদেরও পাশে দাঁড়ান। কিছুটা সাফল্য মেলে। সে সময়ে তৎকালীন ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েত প্রধান সন্তোষ দাসও ছিলেন এই তরুণদের সঙ্গে।

বছর দু’য়েক আগে পেট্রাপোলে নতুন পুলিশ থানা হওয়ার পরে পরিস্থিতি আরও পাল্টেছে। নেশাড়ু ও বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ধরপাকড় হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। এখন নেশাড়ুদের প্রকাশ্যে হুল্লোড় করতে দেখা যায় না। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কারবারিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। অনেকে ভয়ে হেরোইন বিক্রি বন্ধ করে পেশা বদলে নিয়েছে।

তবে নেশার টান পুরোপুরি ছাড়েনি বলেই মনে করেন পঞ্চায়েত প্রধান জয়ন্ত বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের ধরপাকড় ও আমাদের নিয়মিত প্রচারের ফলে হেরোইনের নেশা ও বিক্রি অনেকটাই কমেছে। তবে এখনও গোপনে কেউ কেউ বিক্রি করছে। মোবাইলে অর্ডার দিলে হেরোইন পৌঁছে যাচ্ছে বলেও আমরা শুনেছি।’’

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drug addiction Drug Selling Bongaon
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE