Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পাঁচিল ভাঙুন শিক্ষকেরা, দাপিয়ে বেড়াবে ওরা

রাজ্য জুড়ে সব স্কুলে ‘নির্মল বিদ্যালয় অভিযান’ পালনের সরকারি নির্দেশ এল। তা সফল করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম ছাত্র-শিক্ষকে মিলে।

উড়ান: ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিঙ্গলগঞ্জ কনকনগর এসডি ইনস্টিটিউশনের ছাত্রীরা। —নিজস্ব চিত্র।

উড়ান: ফুটবল মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হিঙ্গলগঞ্জ কনকনগর এসডি ইনস্টিটিউশনের ছাত্রীরা। —নিজস্ব চিত্র।

পুলক রায়চৌধুরী 
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:২৮
Share: Save:

 মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। রাজ্য জুড়ে সব স্কুলে ‘নির্মল বিদ্যালয় অভিযান’ পালনের সরকারি নির্দেশ এল। তা সফল করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম ছাত্র-শিক্ষকে মিলে।

প্ল্যাকার্ড তৈরি করে, গ্রামীণ র‌্যালির প্রস্তুতি নিয়ে, ছেলেমেয়েদের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে দাঁড় করানো হল। উদ্দেশ্য স্বাস্থ্য-বিধানের ‘শপথ’ নেওয়া। খাওয়ার আগে কী ভাবে হাত ধুতে হবে, হাত ধোয়ার ঠিক পদ্ধতি কোনটা, কোন ধরনের খাবারে পুষ্টি বেশি, কোন খাবার খেতে হবে— ইউনিসেফ এবং স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশিকা মেনে, এ সবই শুরু হয়েছিল সে দিন। মিনিট পনেরো কি কুড়ি হবে, হঠাৎ ছেলেমেয়েদের মধ্যে তুমুল হইচই।

কী হল?

দেখা গেল, অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়ানো এক ছাত্রী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। তাকে কোনও রকমে পাঁজাকোলা করে নিয়ে অফিসে ছুটতে না ছুটতেই আবার চিৎকার! ছেলেমেয়েরা সমস্বরে জানাল, ‘স্যর, আরও এক জন!’

অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। সদ্য সুন্দরবন হিঙ্গলগঞ্জের একটি গ্রামের স্কুলের হেড মাস্টারের দায়িত্ব নিয়েছি তখন। স্থানীয় মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা অবশ্য বিস্মিত হননি। অভিজ্ঞ আর শান্ত স্বরে তাঁদেরই এক জন বলছিলেন, ‘এ সবে আমাদের গা সয়ে গিয়েছে স্যর! এই রকম অনুষ্ঠানে ওরা হামেশাই অজ্ঞান হয়! আমরাও ওদের চোখ-মুখে জল দিয়ে, নুন-চিনির শরবত খাইয়ে, সুস্থ করে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। তার পরে আবার যথারীতি অনুষ্ঠান চলে!’ আমারও হয়তো সে দিন এ সব শুনে, ‘শান্ত আর অভিজ্ঞ’ আচরণ করাই উচিত ছিল। কিন্তু ‘শিক্ষকের অন্তরাত্মা’ প্রশ্নগুলো তুলেই ফেলল!

মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলাম, এমন ঘটা করে কাদের স্বাস্থ্য-বিধানের শপথ নেওয়াচ্ছি? যারা পনেরো মিনিটও সোজা হয়ে মাটিতে দাঁড়াতে পারে না, তাদের? শিক্ষকদের গা সয়ে গেলে চলবে না, এটা বুঝেছিলাম সে দিন। গা সয়ে গেলেই, গিলে খাবে গড্ডলিকা। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সমাজে লালিত-পালিত ছকগুলো ভাঙার শপথ নিতে হবে শিক্ষকদেরই। অর্থাৎ, লেখাপড়ার পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের পুষ্টি-সুরক্ষার তদারকিও আমাদের চালাতে হবে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে শুরু করেছিলাম অপুষ্টির কারণগুলো খোঁজা দিয়ে। তার পরে তা থেকে বার করে আনার উপায়ের সন্ধান ও সাধ্যের মধ্যে থাকা উপায়গুলো বাস্তবায়িত করা।

স্কুলের একটা পুকুর ছিল। যথারীতি সে পুকুর লিজ দেওয়া ছিল। মানে, পুকুরে মাছ ছিল। কিন্তু পড়ুয়াদের পাতে তা পড়ার অধিকার ছিল না। অনেক টাকা দিয়ে অবশেষে সেই পুকুর ও মাছের অধিকার পেল স্কুল। সেই মাছ পড়ল পড়ুয়াদের মিড-ডে মিলের পাতে। কৃতিত্ব স্কুলের শিক্ষকদেরই। ‘পুষ্টি সুরক্ষার’ একটা সামান্য ধাপ পেরোতে পেরেছিলাম। সঙ্গে এক লাফে বাড়ল ছেলেমেয়েদের হাজিরাও!

পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল আলিয়ার গাজি। ঘনঘন কামাই লেগেই থাকত। যে দিন সে আসত, ক্লাসে পড়া জিজ্ঞেস করলে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই জানত সে ছেলে। আমাদের শিক্ষকেরাও হতাশ! ক্লাসে গিয়ে দেখলাম, আলিয়ারের খাতায় কয়েকটা আঁকিবুঁকি ছাড়া আর কিছু নেই। স্কুলের বয়স্ক মাস্টারমশাই প্রায়ই বলতেন, “আপনিই বলুন স্যর, এই সব ছেলেমেয়েদের কী পড়াব!”

ষষ্ঠ শ্রেণির জ্যোতির্ময়। নিচু ক্লাসে তবু একটু পড়াশোনা করত। কিন্তু যত উঁচু ক্লাসে উঠেছে, ততই ওর ‘জ্যোতি’ ম্লান হয়েছে। অভিভাবককে ডাকা হল স্কুলে। মন দিয়ে সব শুনে তাঁর উত্তর, “প্রাইভেটে তো দিয়েছি, স্যর!” সব সমস্যার যেন একটাই তাবিজ!

সমস্যাটা শুধু হিঙ্গলগঞ্জে নয়, সর্বত্র। নিজের নামটুকুও ঠিকঠাক লিখতে না পারা ছাত্রছাত্রী রাজ্যের নানা স্কুলে ছড়িয়ে আছে। ‘এসার’ বা ‘প্রথম’ নামক সংস্থাগুলোর দেশজোড়া রিপোর্টে এই ‘না পারাটা’ই ধুমধাম করে প্রকাশিত হয়। সরকার অস্বস্তিতে পড়ে রিপোর্ট তলব করে। সর্বশিক্ষা বা শিক্ষা দফতর কাগজ-কলমে ‘সমাধান’ চায়। স্কুলগুলোও একটা সমাধান ‘বানিয়ে’ ফেলে। এটাই গড্ডলিকা।

স্কুলে এক দিন ৩৫০ ছাত্রছাত্রীর চোখ পরীক্ষা হল। ৩৫ জনকে চিহ্নিত করা গেল, যাদের চোখের অবস্থা খুব খারাপ। মাইনাস ১.৭৫ থেকে ০.৫ পর্যন্ত পাওয়ার যাদের, তাদের আগে চোখ পরীক্ষাই হয়নি! ডাক্তারবাবু বলেন, ‘‘দু’-তিন জনের চোখ এতই খারাপ যে, বিনা চিকিৎসায় আর বছর দুয়েক রাখলে অন্ধ হয়ে যেতে পারে!” ‘কোনও প্রাথমিক স্কুলে পড়ানো হয় না’, ‘হাইস্কুল শিক্ষকদের সেই ছাত্র দরদ আর নেই’— এমন চাপান-উতোরে ছাত্রছাত্রীদের ‘পিছিয়ে পড়ার’ একটা গুরুতর কারণ অজানাই থেকে যেত যদি সে দিন ছক ভাঙার শপথ না নিতাম।

ছাত্রছাত্রীদের ‘পিছিয়ে পড়ার’ একটা বড় কারণ অপুষ্টি ও তা থেকে তৈরি চোখের সমস্যা, এটা অস্বীকার করি কী ভাবে? গ্রামের স্কুলে প্রায় ১০% ছাত্রছাত্রী চোখের সমস্যায় ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে পায় না, এটা আমরা কবে বুঝব? হতে পারে ২০-৫০% ছাত্রছাত্রী অপুষ্টির শিকার, হতে পারে ওদের বাবা-মা ‘প্রাইভেটে দিয়েছি’ ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন না— তাই বলে আমরাও ভাবব না?

টিফিনের সময়ে ওরা টিচার্স রুমের সামনে এখন ঘুরঘুর করে। কখনও ক্রীড়া শিক্ষক, কখনও আমার কাছে আব্দার, ‘আজ খেলি, স্যর?’

“আজ খুব রোদ্দুর! আজ থাক,” বলতেই ওরা আরও নাছোড়বান্দা হয়ে ওঠে। ‘কিচ্ছু হবে না স্যর! আমরা ছায়ার দিকটায় খেলব।’

ওদের আব্দারে আমাদের ‘শিক্ষকসুলভ গাম্ভীর্য’ ভেঙে পড়ে। এমন উৎসাহের কাছে এ ভাবেই সব রোদ্দুর চিরকাল জব্দ হয়। অবলীলায় মাঠে নামে ৩০-৩৫টি মেয়ে। ওদের বন্ধুরাই কয়েক বছর আগে, পনেরো মিনিট দাঁড়ালে মাথা ঘুরে পড়ে যেত। ওই ওরাই আমাদের হিঙ্গলগঞ্জের ছাত্রী। ফুটবল নিয়ে স্বপ্ন দেখা আমাদের এক ঝাঁক উজ্জ্বল পায়রা!

সমাজের সামগ্রিক মানসিকতায় যে সব উঁচু উঁচু পাঁচিল থাকে, তাকে টপকাতেই হবে। পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠানের ভিতরে উঁচু পাঁচিলটাকে আলগা করে দিতে হবে। তবেই তো মুসলিমা, আঞ্জুরা, কুনচুমেরা রোদ্দুর মাথায় করে দাপিয়ে বেড়াবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teachers day Teacher শিক্ষক
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE