Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

যাওয়া হল না রাজস্থানে

দরজা-জানালা খোলা থাকলে মশা ঢুকবে যে। মশা দেখলেও আতঙ্কে পড়ে যান বাবা আর দুই মেয়ে। সামান্য একটা মশার কামড়েই যে ছারখার হয়ে গিয়েছে গোটা পরিবার।

—প্রতীকী চিত্র

—প্রতীকী চিত্র

সুপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০২:২৮
Share: Save:

হাওড়া থেকে সোনার কেল্লা কত দূর? গোলাপি শহর জয়পুরের হাওয়া মহল?

সব উত্তর জানে নবম শ্রেণির মেয়েটি। শুধু দূরত্ব? রাজস্থানের এই সময়ের আবহাওয়া, সেখানকার কোন শহরের কোন খাবার স্পেশাল— সব নখদর্পণে স্নেহার। না হলে বা চলবে কী করে! আর দু’দিন মোটে হাতে। তার পরেই তো ট্রেন। অষ্টমীর সকালে সারা কলকাতা যখন অঞ্জলির তোড়জোড় করবে, তখন তার পুরো পরিবার ট্রেনে।

এমন সময়েও শ্যামনগরের ঘটক বাড়িতে কিন্তু কোনও তোড়জোড় নেই! আলমারির মাথায় তুলে রাখা বাক্স-প্যাঁটরায় ধুলো জমছে। নতুন জামাকাপড় আলমারি-বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। পুজোর মুখে গেরস্থ বাড়ির কলিটুকুও ফেরানো হয়নি। ঘরের মেঝেয় অগোছালো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেরস্থালির নানান জিনিসপত্র। তা হলে কী?

না, রাজস্থান যাওয়াটা এ বার হচ্ছে না ঘটক বাড়ির সদস্যদের। ট্রেনের টিকিটটা ঘরেই পড়ে থাকবে। যখন অষ্টমীর পুজোয় মাতবে সারা শহর, ঘটকবাড়ির দরজা-জানালা তখনও বন্ধই থাকবে। যেমন থাকছে গত দু’মাস ধরে। দরজা-জানালা খোলা থাকলে মশা ঢুকবে যে। মশা দেখলেও আতঙ্কে পড়ে যান বাবা আর দুই মেয়ে। সামান্য একটা মশার কামড়েই যে ছারখার হয়ে গিয়েছে গোটা পরিবার।

একটা জলজ্যান্ত মানুষকে চোখের সামনে চলে যেতে দেখেছেন সঙ্গীতা। যাঁকে আজন্ম মা বলে জেনে এসেছেন, সেই শিবানী ঘটক কী করে যে আর সকলের কাছে মুহূর্তের মধ্যে ‘বডি’ হয়ে গেল, ভাবলে এখনও গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে কষ্টটা। আড়াই দিনে চারটে হাসপাতাল ঘুরে সঙ্গীতারা জানতেই পারেননি, তাদের মায়ের কী হয়েছে। শেষমেশ ডেথ সার্টিফিকেট জানিয়েছিল, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন শিবানী।

বিকেলের আধো অন্ধকারে মায়ের ছবি আঁকড়ে বসে থাকে শিবানীর তরুণী আর কিশোরী দুই মেয়ে— সঙ্গীতা এবং স্নেহা। পাড়ার মণ্ডপে প্রতিমা এসে গিয়েছে। ছেলে-ছোকড়ার দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে। বটানিতে মাস্টার্স করা সঙ্গীতা বলেন, ‘‘মা যে নেই, সেটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না জানেন। আমাদের পুরো জগৎটাই তো মাকে ঘিরে। বাবা পুলিশের চাকরি করতেন বলে সব সময়ে বাইরে বাইরে থাকতেন। মায়ের চলে যাওয়ার ধাক্কাটা বোন এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।’’

বাড়ির কর্তা শঙ্কর ঘটক পুজোর সময়ে কোনও দিন বাড়িতে আসতে পারতেন না। তার ফলে বাড়িটাই ফাঁকা ফাঁকা লাগত সকলের কাছে। শঙ্করই শিবানীকে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যানটা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘তোমরা বরং ট্র্যাভেল এজেন্টের সঙ্গে এই সময়ে বাইরে ঘুরে এস। ভাল লাগবে। সেই থেকে কোনও বার কাশ্মীর, তো কোনও বার উত্তরাখণ্ড চলছে।’’

১৬ অগস্ট জ্বর শুরু হয় শিবানীর। তার পরে শুরু হয়ে এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতাল। প্লেটলেট বেশি ছিল বলে কলকাতার এক হাসপাতাল ১৭ তারিখ তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে দেয়। সে রাতেই ফের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল তাঁকে। তার পরে আরও দু’টো হাসপাতাল। ১৯ তারিখ সব শেষ।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে ঘটক পাড়ায়। খাটে পড়ে থাকা মায়ের ছবিটা সযত্নে তাকে তুলে রাখে স্নেহা। পাড়ার মণ্ডপে গান বেজে ওঠে— ‘সেদিনও আকাশে ছিল কত তারা...’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

death Dengue Family
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE