জয়ের-হাসি: বিজেপি প্রার্থী। নিজস্ব চিত্র
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সে দিনই।
ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভায় লক্ষ লক্ষ লোকের ভিড়ে তখন উপচে পড়ছে ঠাকুরনগরের মাঠ। জনপ্লাবনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে গোটা এলাকা। সভায় আসা মতুয়া ভক্তদের উচ্ছ্বাস দেখে দৃশ্যতই সন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীকে। ক’দিনের মধ্যেই পাশের মাঠে যখন সভা করল তৃণমূল, মাঠ তো ভরেইনি, মতুয়া ভক্তদেরও বড় একটা চোখে পড়েনি সেই সভায়।
যে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কের ভরসায় ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে একের পর এক ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাসি চওড়া হয়েছে, সেই মতুয়ারাই এ বার মুখ ফিরিয়ে নিল তৃণমূলের দিক থেকে। নিট ফল, বৃহস্পতিবার সন্ধে পর্যন্ত হিসেবে প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার ভোটে বনগাঁ কেন্দ্রে এগিয়ে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর। জয় ঘোষণা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
কিন্তু কেন এমন অবস্থা হল তৃণমূলের? কেন ধরাশায়ী তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর?
বনগাঁর বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে তার অনেক ব্যাখ্যা। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন বনগাঁয় মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির জন্য উন্নয়নের বহু কর্মসূচি নিয়েছেন তিনি। মতুয়াদের ধর্মগুরু হরিচাঁদ গুরুচাঁদের নামে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে চাঁদপাড়ায়। মতুয়াদের বড়মা বীণাপানি ঠাকুরের স্বামী, আর এক মতুয়া ধর্মগুরু প্রমথরঞ্জনের নামে কলেজ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই। কিছু দিন আগে বড়মাকে বঙ্গভূষণ সম্মান দিয়েছে রাজ্য। মতুয়াদের পুণ্যস্নানের জন্য কামনাসাগরের সংস্কার করা হয়েছে। ঠাকুরনগর স্টেশনের রূপ বদলে মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির আদল দেওয়া হয়েছে। গোটা বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বিভিন্ন জায়গায় উন্নয়নের অনেক কাজ হয়েছে— মানছেন অনেকেই। তারপরেও এই কেন্দ্রে জিততে পারলেন না তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর।
বিজেপি বারাসত সাংগঠনিক জেলার সভাপতি প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, মোদীজি ঠাকুরনগরের সভায় এসে বলে গিয়েছিলেন, যে সব হিন্দু বাংলাদেশ থেকে এ দেশে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। মতুয়ারাও দীর্ঘ দিন ধরে নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলন চালাচ্ছেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কথায় আস্থা রেখেছেন। বরং এনআরসি নিয়ে তৃণমূলের প্রচার মানুষের মনে তেমন দাগ কাটেনি বলেই মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
মতুয়াদের বড় অংশের ভোট তিনি পেয়েছেন বলে মনে করছেন শান্তনুও। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু আমি নই, এ বার মতুয়া ভক্তদের সমর্থন পেয়েছেন বিজেপির অন্য প্রার্থীরাও।’’
শান্তনু যে মতুয়া ভক্তদের একটা অংশের ভোট পেয়েছেন, তা স্বীকার করছেন মমতা ঠাকুরও। পাশাপাশি তাঁর দাবি, ‘‘মতুয়াদের একটা বড় অংশ এখনও আমার সঙ্গেই আছেন।’’
সিপিএমের গতবার প্রায় ২৬ শতাংশ ভোট ছিল বনগাঁ কেন্দ্রে। এ বার সেই ভোট অনেকটাই কমেছে বলে জানালেন প্রার্থী অলকেশ দাস। বিষয়টি ‘উদ্বেগজনক’ বলে মনে করছেন তিনি। সিপিএমের বড় অংশের ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছে বলে মনে করছেন বাম নেতারা।
এ ছাড়াও এই কেন্দ্রে বিজেপির ভাল ফল হওয়ার আরও কয়েকটি কারণ উঠে আসছে রাজনৈতিক মহলের আলোচনায়।
মতুয়াদের ঠাকুরবাড়ির দুই আত্মীয় মমতা এবং শান্তনু এ বার মুখোমুখি লড়েছেন ভোটে। দু’জনেই মতুয়াদের ধর্মীয় সংগঠনের নেতৃত্ব দেন। কিন্তু বড়মাকে তাঁদের ‘নিজেদের লোক’ হিসাবে প্রমাণের জন্য তৃণমূল যে ভাবে জান লড়িয়ে দিয়েছে নানা সময়ে, সেটা মতুয়া ভক্তেরা ভাল চোখে দেখেননি বলে জানাচ্ছেন ভক্তদের অনেকে। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী-সহ বিজেপির নানা নেতার সভা করা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যে প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তা-ও ভাল চোখে দেখেননি অনেকে।
পঞ্চায়েত ভোটে বনগাঁর নানা প্রান্তে সন্ত্রাসের জেরে অনেকে ক্ষুব্ধ ছিলেন তৃণমূলের উপরে। বিশেষত বাগদায় অনেকে ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ ওঠে। মনোনয়নের সময় থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। তারপরেও বনগাঁয় ৪টি পঞ্চয়েত দখল করে বিজেপি। বনগাঁর ৭২৪টি পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে ২১০টিতে জয়ী হয় তারা।
বাগদার বিধায়ক দুলাল বরের এলাকা প্রভাব ভালই। কিন্তু তিনি যোগ দেন বিজেপিতে। ভাবা গিয়েছিল, শান্তনু প্রার্থী হওয়ায় তিনি হয় তো প্রচারে গা ঘামাবেন না। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি। বাগদায় তৃণমূলের গতবারের বিধায়ক উপেন বিশ্বাস দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু জেলা নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে তাঁর বিরোধের জেরে বাগদায় আসাই ছেড়ে দেন উপেন। সে কথা মাথায় রেখে উপেন-অনুগামী ‘বসে যাওয়া’ দলের কর্মীদের চাঙ্গা করতে বাগদার সভায় এসে মুখ্যমন্ত্রীকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপেনের প্রশংসা করতে হয়েছিল। তারপরেও তৃণমূলের একাংশ দলের প্রচারে তেমন গা ঘামায়নি বলে অভিযোগ শোনা যায় দলের অন্দরেই। বনগাঁর পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য বাগদায় দলের দায়িত্বে আছেন। তাঁকে ‘বহিরাগত’ বলে মনে করেন স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই।
গোবরডাঙা, বনগাঁয় তৃণমূল নেতাদের একাংশের আচার-আচরণ নিয়েও বেশ কিছু দিন ধরেই ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন মানুষ। স্বজনপোষণ, দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ তো ছিলই, নেতাদের অনেকের ব্যবহারেও তিতিবিরক্ত ছিলেন মানুষ। বনগাঁ শহরে ঘাসফুল শিবিরের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে ভয় পেতেন অনেকে।
বনগাঁ শহরের এক যুবকের কথায়, ‘‘আমাদের তো চায়ের দোকানে বসেও খোলা মনে কথা বলার অধিকার ছিল না। বনগাঁর মানুষের দমবন্ধ হয়ে আসছিল।’’ পদ্ম শিবিরে বোতাম টিপে দম ফেলার পথ পেল কিনা বনগাঁ, এখন সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy