Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মৃত্যুর পথে নদী

স্রোতহারা ইছামতীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারে নেই কোনও উদ্যোগ

গতি হারিয়ে এমনই অবস্থা ইছামতীর। অতীতে যেখানে নৌকো চলত নিয়মিত, সেখানে নদীর পাড়ে এখন দু’চারখানা ভাঙা নৌকো পড়ে থাকতে দেখা যায়। 

স্রোতহীন: পাবাখালিতে নদীর উপরে চর পড়ে ক্রমে তা রাস্তার চেহারা নিয়েছে।

স্রোতহীন: পাবাখালিতে নদীর উপরে চর পড়ে ক্রমে তা রাস্তার চেহারা নিয়েছে।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৯ ০৪:২৭
Share: Save:

এক সময়ে এই নদীই ছিল জেলার জীবনরেখা। সেই এখন স্রোত হারিয়ে মৃত্যুর দিন গুনছে। কোথাও চর পড়ে নদীর উপর দিয়ে তৈরি হয়েছে পথ। কোথাও কচুরিপানা জমে জলস্তর চোখেই পড়ে না।

গতি হারিয়ে এমনই অবস্থা ইছামতীর। অতীতে যেখানে নৌকো চলত নিয়মিত, সেখানে নদীর পাড়ে এখন দু’চারখানা ভাঙা নৌকো পড়ে থাকতে দেখা যায়।

খাতায়-কলমে নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জের মাজদিয়ার পাবাখালিতে চূর্ণী ও মাথাভাঙা নদীর সংযোগস্থলে মাথাভাঙা নদী থেকে ইছামতীর সৃষ্টি। কিন্তু এখন মাথাভাঙা থেকে ইছামতী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ফলে বহু অংশে চর পড়েছে। কখনও-সখনও সেখানে জল ওঠে। কিন্তু বাকি সময়ে থাকে শুকনো।

পাবাখালি থেকে ফতেপুর পর্যন্ত ইছামতীর প্রায় সাড়ে ১৯ কিলোমিটার পথই জলশূন্য। সেখানে ধানচাষ হয়। যদিও বছর পঞ্চাশ আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না, জানাচ্ছেন প্রবীণ মানুষজন। তাঁদেরই এক জন পরিমল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে স্মৃতিতে ডুব দিয়ে বলেন, ‘‘ছেলেবেলায় দেখেছি নদী আরও চওড়া ও গভীর ছিল। জল ছিল কালো। জোয়ার-ভাটা খেলত। নদীতে সাঁতার কাটতাম। এখন সে সব গল্পকথা মনে হয়।’’

বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার মুন্সিগঞ্জের পদ্মা থেকে মাথাভাঙার সৃষ্টি। মাথাভাঙাতেও এখন স্রোত নেই। উৎসমুখে ইছামতীর এই অবস্থা হল কী করে?

স্থানীয় ইতিহাস ও প্রবীণ মানুষেরা জানালেন, ব্রিটিশ আমলে পাবাখালিতে ইছামতী নদীর উপরে একটি রেলব্রিজ তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটির কর্ণধার সুভাষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রেল দুর্ঘটনায় ব্রিজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯১০ সাল নাগাদ রেলব্রিজের সংস্কার করার সময়ে বড় বড় বোল্ডার ফেলা হয়েছিল। যা আর তোলা হয়নি। জলের চাপ সামলাতে দেওয়া হয়েছিল গার্ডওয়াল।’’ এর ফলে ধীরে ধীরে নদীবক্ষে পলি জমতে থাকে। পরবর্তী সময়ে বাম আমলে নদীর জমি পাট্টা হিসাবে বিলি করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে নদী ওই এলাকায় জলশূন্য হয়ে পড়েছে বলে তিনি জানান।

ইছামতী উৎসমুখ হারিয়ে ফেলায় ভারী বৃষ্টি হলে বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। ঘরবাড়ি ছেড়ে মানুষের দুর্দশার শেষ থাকে না। সাধারণ মানুষের দাবি মেনে, কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে বিক্ষিপ্ত ভাবে নদী সংস্কারের কাজ যে হয়নি তা নয়। কিন্তু স্রোত ফেরেনি। সংস্কার হয়নি নদীর উৎসমুখও।

পশ্চিমবঙ্গ ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটির পক্ষ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে ইছামতীর উৎসমুখ-সহ সংস্কারের দাবি তোলা হচ্ছে। দীর্ঘ দিন নদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বনগাঁর আইনজীবী স্বপন মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ইছামতী নদীকে বাঁচাতে হলে উৎসমুখ সংস্কার করতেই হবে। না হলে নদীকে বাঁচানো সম্ভব নয়।’’ সুভাষ বলেন, ‘‘উৎসমুখে নদীবক্ষ থেকে ৮ মিটার করে পলি তুলে নদী সংস্কার করতে পারলে নদী পুরনো চেহারায় ফিরবে। পাশাপাশি নদীর যে ৩৭ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে, তারও সংস্কার প্রয়োজন। শীঘ্রই রাজ্যের সেচমন্ত্রীর কাছে ওই দাবি জানানো হবে।’’ নদী বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ইছামতীর গতিপথ জুড়ে তলদেশের অবস্থা খতিয়ে দেখা জরুরি। সেটি তৈরি হলে নদীর বাস্তব পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র জানা যাবে। সেই মতো সংস্কারের কাজও সহজ হবে।

সম্প্রতি বনগাঁ মহকুমা প্রশাসনের উদ্যোগে নদী থেকে কয়েক টন কচুরিপানা তোলা হয়েছে। মানুষ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কচুরিপানা তুলেছেন। মহকুমাশাসক কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই কচুরিপানা দিয়ে জৈব সার তৈরি করা হচ্ছে। ডিসেম্বর থেকে তা বিক্রি করা হবে।’’ নদিয়ার দত্তপুলিয়া সংলগ্ন এলাকাতেও মানুষ নিজেরা প্রায় ১২ কিলোমিটার নদী কচুরিপানা মুক্ত করেছেন। বনগাঁ মহকুমায় নদীর করুণ অবস্থা হলেও বসিরহাটের হাসনাবাদ এলাকায় অবশ্য নদী স্বমহিমায় রয়েছে। সেখানে আজও জোয়ার-ভাটা খেলে। কিন্তু উৎসমুখ সংস্কার না হলে নদীর সামগ্রিক স্বাস্থ্য যে ফিরবে না, তা মনে করেন সকলেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ichamati River Dying River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE