Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

রাজ্জাক চেয়ে আছেন ইভিএমের দিকে

লোকসভায় নিজের ভোটটা দিতে পারলে কি রাজ্জাকের আপসোস কিছুটা কমবে?

রাজ্জাক গাজি। নিজস্ব চিত্র

রাজ্জাক গাজি। নিজস্ব চিত্র

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৯ ০৯:৩৮
Share: Save:

বাঘ ঠেকাতে পারলেন, কিন্তু নিজের ভোটটাই দিতে পারলেন না!

হিঙ্গলগঞ্জ থানার কাটাখালি গ্রামের ইছামতী ও গৌড়েশ্বর নদী দিয়ে ঘেরা কোনাপাড়ায় থাকেন বছরপঁয়ষট্টির রাজ্জাক গাজি। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি রাজ্জাক।

দেবেনই-বা কী করে? সে বার বসিরহাট মহকুমার ৯০ শতাংশ আসনে প্রার্থীই ছিল না!

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়েও নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন রাজ্জাক। বাঘ ঠেকাতে পারলেও তাঁর অভিযোগ, হার মেনেছিলেন ভোট-সন্ত্রাসের কাছে! ফলে আপসোস যায় না।

স্ত্রী রোকেয়া বিবি, তিন ছেলে-বৌমা এবং নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার রাজ্জাকের। সুযোগ পেলেই গায়ে বাঘের আঁচড়-কামড়ের দাগ দেখান নাতি-নাতনিদের। কী ভাবে বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে বাঘ তাড়িয়েছিলেন, সেই গল্প ওদের শুনিয়েও নিশ্চিত শ্লাঘা বোধ করেন। তবু রজ্জাকের দুঃখ গভীর। বাঁশ দিয়ে বাঘ পেটাতে পারলেন, কিন্তু একটা বোতাম টিপে নিজের ভোটটা দেওয়া হল না!

পঁচিশ বছর আগের কথা। ছ’জন সঙ্গীকে নিয়ে রাজ্জাক মধু ভাঙতে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের চামটার জঙ্গলে। তিন দিন কেটে গিয়েছে। একদিন সকালে সবে ভাত খেতে বসেছেন। এমন সময়ে একটু দূরে সুন্দরী গাছের ডালে ১০-১২টি মৌচাক নজরে এল। লোভে পড়ে খাল পেরিয়ে গিয়ে দ্রুত চাক কেটে নৌকায় এনে রাখছিলেন। হঠাৎ কয়েকটি বাঁদরকে কিচমিচ শব্দ করে পালাতে দেখে বিপদের গন্ধ পান একাধিকবার জঙ্গলে যাওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজ্জাক। দ্রুত পিছনে ফিরে তাকান। ততক্ষণে বড় আকারের এক রয়্যালবেঙ্গল তাঁকে লক্ষ্য করে লাফ মেরেছে। রাজ্জাক ঝটতি সরে গেলেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাঘ পড়ল খালের কাদায়।

ততক্ষণে একজন ছাড়া তাঁর বাকি সঙ্গীরা নৌকায় উঠে পড়েছেন। নীচে দাঁড়ানো সঙ্গীটি জ্ঞান হারিয়েছেন। রাজ্জাক বুঝে যান, যা করার তাঁকে একাই করতে হবে। হাতের বাঁশের লাঠি বাগিয়ে ধরলেন। কিন্তু লাঠিতে কি বাগ মানে বাঘ! বাঘ তাঁর পিঠে, ঘাড়ে থাবা বসিয়ে দিয়েছে। মাথাটা মুখে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রক্তে ভিজে যাচ্ছিল রাজ্জাকের শরীর। সে সময়ে জ্ঞান ফিরে আসে তাঁর সঙ্গীর। দু’জনে মিলে বাঁশের লাঠি দিয়ে লড়ে যান। শেষমেশ বাঘ তাঁদের ছেড়ে জঙ্গলে ফিরে যায়। রাজ্জাকের শরীরে ২৭৫টি সেলাই পড়েছিল। দীর্ঘ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা হয় তাঁর।

বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আঠারো ঘা সামলেও নিয়েছেন রাজ্জাক। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোট দিতে না পারাটা তাঁর মনে যে গোপন ঘা তৈরি করেছে, তার হাত থেকে এখনও রেহাই মিলল না রাজ্জাকের।

রাজ্জাক বলেন, ‘‘বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের পরে সে সময়ের সরকারের পক্ষে চিকিৎসার খরচ মিলেছিল। এখনকার সরকার স্বল্পমূল্যে চাল-আটা দিচ্ছে বটে, কিন্তু বেকারভাতা বা ঘর কিছুই পাই না। কোনও প্রকল্পের সুবিধাও মেলেনি।’’ নদীর চরে বাস করেন। বিড়ি বেঁধে এবং ইটভাটায় কাজ করে কোনও রকমে সংসার চালান। রাজ্জাকের কথায়, ‘‘পঞ্চায়েতে বিরোধীদের কোনও প্রার্থীই দিতে দেওয়া হয়নি। এ বার কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকায় মনে হয় ভোটটা দিতে পারব।’’

বসিরহাট বিধানসভার তৃণমূলের আহ্বায়ক ফিরোজ কামাল গাজি অবশ্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘প্রার্থী না দাঁড়ালে আমরা কী করব? তাই ভোট দিতে না দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। তা ছাড়া, আমরা তো ওঁকে দু’টাকা দরে চাল এবং ওঁর বড় ছেলেকে ঘর দিয়েছি।’’

পেটের ভাত হয় তো মিলেছে, কিন্তু আত্মসম্মানের পুনরুদ্ধার হয়নি। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে জিতে যাওয়ার বীররসের কথা মনে পড়ার পাশাপাশি ভোট দিতে না পারার করুণরসও যে নিত্য জেগে ওঠে রাজ্জাকের মনে। লোকসভায় নিজের ভোটটা দিতে পারলে কি তাঁর এই আপসোস কিছুটা কমবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE