Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
বিধানসভা ভোটে মার দিয়েও দমিয়ে রাখা যায়নি যাঁদের

ভোট যখন প্রতিবাদ

সে বার আতঙ্ক কাটিয়ে তবু ভোটটা দিয়েছিলেন দেবশ্রী। এ বারও অন্যথা হয়নি। হালিশহরের দেবশ্রী ঘোষের কথায়, ‘‘পরিস্থিতি যা-ই ঘটুক, ভোট দেব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম।’’

সে বার আতঙ্ক কাটিয়ে তবু ভোটটা দিয়েছিলেন দেবশ্রী।—নিজস্ব চিত্র।

সে বার আতঙ্ক কাটিয়ে তবু ভোটটা দিয়েছিলেন দেবশ্রী।—নিজস্ব চিত্র।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৯ ০৩:০৩
Share: Save:

সে বার যখন ভোটের লাইনে মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে দেবশ্রী, সারা শরীরে ব্যথা। ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে আবার কিছু ঘটবে না তো!

সে বার আতঙ্ক কাটিয়ে তবু ভোটটা দিয়েছিলেন দেবশ্রী। এ বারও অন্যথা হয়নি। হালিশহরের দেবশ্রী ঘোষের কথায়, ‘‘পরিস্থিতি যা-ই ঘটুক, ভোট দেব বলে ঠিক করে রেখেছিলাম।’’

২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল দিনটা কখনও ভুলতে পারেন না রামপ্রসাদের ভিটে-সংলগ্ন বারেন্দ্রগলির বাসিন্দা দেবশ্রী। বাড়িতে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা। হঠাৎই চড়াও হয় কিছু লোক। গালিগালাজ করতে করতে ঢুকে পড়ে। বলে, ‘‘বুথের আশেপাশেও যেন না দেখি তোদের। মজা টের পাবি তা হলে!’’

‘মজা’ টের পেতে অবশ্য বুথমুখোও হতে হয়নি। তার আগেই বাড়িতে তাণ্ডব শুরু করে হামলাকারীরা। ভাতের হাঁড়ি উল্টে ফেলে দেয়। দেবশ্রীকে চড়-থাপ্পড় মারে। মারধর করা হয় তাঁর বাবা টিটু সমাজপতিকে। মা-দাদুকে পেটাচ্ছে দেখে ভয়ে কান্না জুড়েছিল সায়ন্তিকা। তাকেও রেহাই দেয়নি হামলাকারীরা। ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। চড় মারে।

গোটা ঘটনাটা যাঁর নেতৃত্বে সে দিন ঘটেছিল বলে অভিযোগ, তিনি দেবশ্রীদের অচেনা নন। হালিশহর পুরসভার তৎকালীন উপপুরপ্রধান রাজা দত্তকে এলাকায় কে না চিনত। তৃণমূল নেতা রাজার দাপটে তখন এলাকায় সকলেই তটস্থ। বাম সমর্থক পরিবারের উপরে হামলা সে কারণেই, অভিযোগ করেন টিটুরা।

তারপরে অবশ্য ঘটনা বহু দূর গড়ায়। এলাকায় জনরোষ তৈরি হয় রাজার বিরুদ্ধে। দীর্ঘ দিন এলাকা ছাড়া ছিলেন তিনি। থানা-পুলিশও হয়। পরে এলাকায় ফিরে উপ পুরপ্রধানের চেয়ার আলো করে বসতে দেখা যাচ্ছিল রাজাকে। ইতিমধ্যে অবশ্য অর্জুন সিংহের হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তিনি।

এ দিকে, দেবশ্রীর স্বামী মারা গিয়েছেন। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে লড়াই চলছে তাঁর। ২০১৬ সালের কথা ওঠায় জানালেন, সে দিন পাড়ার মোড়ে তাঁর দাদা দীপেনকেও মারধর করেছিল রাজা ও তাঁর দলবল। তারপরে তাঁদের বাড়িতে চড়াও হয়। ছোট্ট মেয়েটা এখনও মন থেকে ভয়টা যাচ্ছে না।

দেবশ্রী বলেন, ‘‘ভোটটা দিলাম ঠিকই। কিন্তু চাপা সন্ত্রাসটা রয়েই গিয়েছে।’’ আর সায়ন্তিকার প্রশ্ন, ‘‘ওরা আবার ফিরে আসবে না তো?’’

সন্ত্রাস উপেক্ষা করে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল ভোট দিয়েছিলেন শিবু দাস ও তাঁর স্ত্রী টুলটুলিও। কল্যাণীর বিবেকানন্দ পল্লির বাসিন্দা শিবুরা যখন সে দিন ভোট দিতে ঢুকেছিলেন, তখন শিবুর দু’হাতে প্লাস্টার। কিছুক্ষণ আগেই হামলাকারীরা মেরে তাঁর দু’টি হাতই ভেঙে দেয়।

কালনা পলিটেকনিক কলেজের শিক্ষক শিবুর পরিবারও বামপন্থী হিসাবে পরিচিত। জানালেন, আগের রাতে এলাকার তৃণমূল কাউন্সিলর অমর রায় তাঁর ছেলেদের নিয়ে বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যান। বলেছিলেন, ভোট দিতে গেলে ভাল হবে না।

তবে কতটা খারাপ হতে পারে, তা তখনও আন্দাজ করতে পারেননি শিবুরা। ভোট দিতে যাওয়ার পথে অমররা তাঁদের পথ আটকান বলে অভিযোগ। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় টুলটুলিকে। মেরে হাত দু’টিই ভেঙে দেওয়া হয় শিবুর।

কল্যাণী জেএনএম হাসপাতাল থেকে হাতে প্লাস্টার করিয়ে বেলার দিকে ভোটগ্রহণ কেন্দ্র পৌঁছন শিবুরা। দাঁতে দাঁত চেপে ভোটও দেন। জেদ চেপে যায় তাঁর। শিবু সে দিন বলেছিলেন, ‘‘হাতই যখন ভাঙল, তখন ভোটটা তো দিতেই হবে!’’

অমররা পরে এলাকা ছাড়া হন। অমর ইতিমধ্যে মারাও গিয়েছেন। কিন্তু এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ কি কম?

শিবু জানালেন, প্রচুর কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হয়েছে। তবে চাপা উত্তেজনাটা আছেই। ভোটের দিন রাস্তাঘাট সুনসান।

দু’টো হাতই এখনও ব্যথায় টনটন করে বলে জানালেন মাস্টারমশাই। প্লেট, রড বসেছে সেখানে। আবার ভোট দিতে এলেন যে, ভয় করল না?

শিবুর উত্তর, ‘‘ভোটই হল আমার প্রতিবাদের ভাষা!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE