Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
লোকসভা ভোটের দিন বললেন সন্তানহারা মা-বাবা
Lok Sabha Election 2019

সে বার বাহিনী থাকলে ছেলেটাকে হারাতাম না

ছেলে সুশীলের কথা রবিবার ভোটের দিন মনে পড়েছে তিরাশি বছরের বৃদ্ধা মা লক্ষ্মীরানি দাসের।

হুতাশ: সুশীলের মা লক্ষ্মীরানি। ছবি: সুজিত দুয়ারি

হুতাশ: সুশীলের মা লক্ষ্মীরানি। ছবি: সুজিত দুয়ারি

সীমান্ত মৈত্র
হাবড়া শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৯ ০০:৪৫
Share: Save:

গণপিটুনিতে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে গিয়েছিল বুথের বাইরে। বাইক বাহিনীর তাণ্ডব, ব্যালট লুটের চেষ্টা, ছাপ্পা ভোট, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল হাবড়ার পৃথিবা পঞ্চায়েতের যশুর এলাকা।

সে দিনের ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন উজ্জ্বল শূর ও সুশীল দাস নামে দুই তৃণমূল কর্মী। তাঁরা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন না। বাড়ি হাবড়া পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ হাবড়া এলাকায়। তাঁদের মৃত্যুর পরে পরিবারের দু’জনকে চাকরি দেয় রাজ্য সরকার। ধরপাকড়ও হয় কিছু কিছু।

ছেলে সুশীলের কথা রবিবার ভোটের দিন মনে পড়েছে তিরাশি বছরের বৃদ্ধা মা লক্ষ্মীরানি দাসের। সকালে বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, এক কামরার ঘরের খাটে শুয়ে আছেন। ডাকতেই উঠে এলেন। ভোট দিতে যাবেন না? প্রশ্ন শুনে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধা। বললেন, ‘‘অকারণে ছেলেটাকে ওরা মেরে ফেলল। এক বন্ধু ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।’’ বৃদ্ধার অভিযোগ, যখন ছেলেকে মারা হচ্ছিল, কেউ ঠেকাতেও আসেনি। লক্ষ্মীরানি বলেন, ‘‘ভোটটা দিতে যাব। শুনেছি মিলিটারি থাকছে। ওই ভোটের সময়েও যদি থাকত, ছেলেকে হারাতে হত না।’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

সুশীলের বাড়ির কাছেই বাড়ি উজ্জ্বলের। তাঁর স্ত্রী লিপি ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন, ‘‘স্বামীর খুনিরা আজও সকলে গ্রেফতার হয়নি। ওদের শাস্তি হয়নি। ওদের শাস্তির জন্যই ভোট দিতে যাব।’’ তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতি বুঝি না না। তবে ভোটে হিংসা বন্ধ হোক। আমার মতো কাউকে যেন স্বামীকে হারাতে না হয়।’’ উজ্জ্বলের মেয়ে জুঁই বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে কোনও নিরাপত্তা ছিল না। এ বারের মতো নিরাপত্তা থাকলে বাবাকে মরতে হত না।’’

এ বার অবশ্য ছবিটা অন্য রকম।

রবিবার ভোর ৫টা থেকে লাইনে দাঁড়াতে শুরু করেন মানুষজন। আগ্নেয়াস্ত্র হাতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের তৎপরতা দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হন। অনেকেই জানালেন, ভোর থাকতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন একটাই কারণে। বেলা বাড়লে যদি গোলমাল বাড়ে, সেই আশঙ্কাই কাজ করছিল সকলের মনে। সকাল ৬টার সময়ে মহাত্মা শিশিরকুমার আদর্শ বিদ্যাপীঠ স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, মহিলা-পুরুষদের দীর্ঘ লাইন। ভোট দিতে এসেছিলেন বৃদ্ধ গণেশ দাস। তিনি বলেন, ‘‘সাতসকালে ভোট দিতে এসেছি। তাতে যদি অশান্তি এড়ানো যায়। পঞ্চায়েত ভোটে দুপুরের পরে অশান্তি শুরু হয়েছিল। বহু মানুষ ভোট না বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।’’ বৃদ্ধা বিদ্যারানি দাস, রেখা মজুমদারেরা বলছিলেন, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটের কথা মনে পড়লেই ভয় লাগে। ওই দিন বুথে লাঠি হাতে পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা থাকলে সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটত না। এমন নিরাপত্তা সমস্ত ভোটেই থাকা উচিত।’’

পঞ্চায়েত ভোটের কথা বলতে গেলে এখনও বুক কাঁপে অনেকের। গত বছর ১৪ মে ছিল ভোট। শিশিরকুমার আদর্শ বিদ্যাপীঠে সকাল থেকে নির্বিঘ্নেই ভোট চলছিল। দুপুরের পর থেকে শুরু হয় বাইক বাহিনীর তাণ্ডব। বিকেলে স্কুলের সামনে বাইক নিয়ে হাজির হয় কিছু লোক। অভিযোগ, তারা জোর করে বুথে ঢুকে ছাপ্পা দেওয়ার শুরু করে। ভোটের লাইনে দাঁড়ানো মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। শুরু হয় গোলমাল। উত্তেজিত জনতা দুই যুবককে ধরে গণপিটুনি দেয়। বাইক ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে দিনের মতো ভোটগ্রহণ পণ্ড হয়ে যায়। পরে ফের ভোটগ্রহণ হয় ওই বুথে।

পঞ্চায়েত ভোটে হাবড়ার পৃথিবা, কুমড়া ও মছলন্দপুর-২ পঞ্চায়েত এলাকায় সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছিল বিরোধীরা। এ দিন অবশ্য তেমন কোনও অভিযোগ তোলেনি কোনও পক্ষই। বিজেপির বারাসত সাংগঠনিক জেলার সহ সভাপতি বিপ্লব হালদার বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতিতে তৃণমূলের গুন্ডারা এ বার ট্যাঁ ফু করতে পারেনি।’’ হাবড়া ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের অজিত সাহা বলেন, ‘‘ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছে।’’ সিপিএম নেতা আশুতোষ রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘কয়েকটি এলাকায় আমাদের এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া ভোট শান্তিতেই হয়েছে।’’

পৃথিবা পঞ্চায়েতের হায়দারবেলিয়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, তৃণমূল ও বিজেপি কর্মীরা পাশাপাশি টেবিলে বসে ক্যাম্প অফিস করেছেন। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছেন। তৃণমূল কর্মী শেখ আবদুল আজিজ, বিজেপি কর্মী বিশ্বজিৎ সরকার বলেন, ‘‘আমাদের এখানে কোনও গোলমাল নেই। ভোট শেষে আমাদের তো এক সঙ্গেই মিলেমিশে বাস করতে হবে। কেন খামোখা গোলমাল করতে যাব!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE