আর্জেন্টিনার জার্সি গায়েই দোকানে ব্যস্ত শিবশঙ্কর পাত্র। শুক্রবার, ইছাপুরে। নিজস্ব চিত্র
গোল পোস্টের দিকে লক্ষ্য স্থির। ‘কিক’ করতে প্রস্তুত বগলা। আচমকাই কলকাতার সর্বমঙ্গলা দলের কর্তা কালীপতি দত্ত চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘বগলা আউটে কিক কর, আউটে। আমার টিম কখনও পেনাল্টিতে গোল দেয় না।’
ইছাপুরের বছর পঞ্চাশের শিবশঙ্কর পাত্রও অবশ্য অনেকটা কালীপতির মতো। তিনিও পছন্দ করেন না তাঁর প্রিয় দলের খেলোয়াড়েরা পেনাল্টিতে গোল করুন। তবু আর্জেন্টিনা বনাম আইসল্যান্ডের খেলায় মেসি যখন পেনাল্টি-র সুযোগ পেয়েছিলেন, তখন ইষ্টনাম জপছিলেন শিবেদা।
দাদার কথা মতো গোল পোস্টের বাইরে বল পাঠিয়েও শেষমেশ বগলারা হারিয়ে দিয়েছিলেন ‘ধন্যি মেয়ে’র হাড়ভাঙা ক্লাবকে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি আর্জেন্টিনার। মেসি মিস করেছিলেন পেনাল্টি। আর তাই শেষমেশ রুশ ময়দানে ফুটবলের মহারণে ড্র হয়েছিল আর্জেন্টিনা ও আইসল্যান্ডের মধ্যে।
সে দিনের পর থেকেই মনটা ঠিক নেই নবাবগঞ্জের গঙ্গার ঘাটের কাছে চা আর নোনতা খাবারের দোকানি শিবেদার। সারা দিনই উসখুস করে মনটা। ভাবনায় শুধু মেসি আর আর্জেন্টিনা। সেই ভাবনা নিয়েই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে পরিচিতদের নিমন্ত্রণ সেরে, অতিথিদের মিষ্টির প্যাকেটের অর্ডার দিয়ে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরেছিলেন শিবেদা। আর্জেন্টিনার ভক্ত স্ত্রী স্বপ্নাদেবীও। তাঁকে শিবেদা বলেছিলেন, ‘‘শরীরটা ভাল নেই, আজ শুয়ে পড়ব।’’ বলে অল্প খেয়ে বিছানা নিয়েছিলেন ওই মেসিভক্ত।
কিন্তু রাতে পাড়ার ছেলেদের চেঁচামেচি শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিলেন শিবেদা। হুড়মুড়িয়ে একতলায় টিভির ঘরে গিয়ে দেখেন, তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়ে নেহা কাঁদছেন। বাবাকে দেখে তাঁর মন্তব্য, ‘জঘন্য খেলা হয়েছে। তিন গোলে হেরেছে ক্রোয়েশিয়ার কাছে।’’
বিশ্বকাপ শুরুর আগেই কয়েক হাজার টাকা খরচ করে দোতলা বাড়ি আকাশি আর সাদা রঙে রাঙিয়েছেন শিবেদা। আর সেই আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন প্রায় শেষ হতে বসেছে শুনে মেঝেতেই বসে পড়েন তিনি। শুক্রবার সকালে বললেন, ‘‘সব কিছুর জন্য দায়ী ওই কোচ। দলটার মধ্যে কোনও বোঝাপড়া নেই। মেসিকে কখন বল দিতে হবে, তা-ও তো নতুন খেলোয়াড়েরা জানেন না।’’ তাঁর আরও দাবি, পাঁচ জন সেরা খেলোয়াড়ের মধ্যে তিন জনকে বসিয়ে রাখা একেবারেই ঠিক হয়নি। একই অভিযোগের আঙুল তুলছেন স্বপ্নাদেবী, নেহাও।
শিবশঙ্করবাবু বলছেন, ‘‘কী যে হল! একেবারে ৩২ নম্বরেই বোধহয় চলে গেল আর্জেন্টিনার নামটা।’’ আইসল্যান্ডের সঙ্গে ড্র হওয়ার পরের দিন সকালেই তাঁর দোকানে এসে হাজির হয়েছিলেন পাড়ার বেশ কয়েক জন। টিপ্পনী কেটে তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘কেমন হল?’’ শিবেদা অবশ্য মুখে কিছু না বললেও তখন থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলেন, বৃহস্পতিবার রাতে আর খেলা দেখবেন না। বললেন, ‘‘ভাবলাম, খেলা না দেখলে হয়তো দল জিতবে!’’
তা হল না ঠিকই। কিন্তু তাতে কী! তা-ও ২৪ জুন নবাবগঞ্জে কাটা হবে ৩১ পাউন্ডের কেক। কারণ, ওই দিন যে শিবেদার প্রিয় মেসির জন্মদিন। পুরোহিত এসে মেসির মঙ্গল কামনায় করবেন পুজো-অর্চনা। আর সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে অতিথি, পরিচিতদের নিমন্ত্রণও প্রায় শেষ পর্যায়ে এখন শিবেদার। আকাশি-সাদা রঙের মিষ্টি, লুচি-আলুর দমের প্যাকেটও অর্ডার হয়ে গিয়েছে। আর মেসিকে পঞ্চব্যাঞ্জন সাজিয়ে দিতে হেঁশেলে ঢুকতেও তৈরি স্বপ্নাদেবী।
শিবেদার মতো এখনও বেশ কয়েকটি সমীকরণের উপরে ভরসা রাখছেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা। আর এ দিন সকাল থেকেই বেশ আনন্দে নেমার ও রোনাল্ডোর ভক্তেরা। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঘুরছে টিপ্পনী। কেউ লিখেছেন, ‘হারজেন্টিনা’। কেউ বা ‘আর-জিতিনা’। ঘুরছে ছবি, আর্জেন্টিনার জার্সি পরা ভক্তের মাথায় জল ঢালছেন এক ব্রাজিল সমর্থক।
যদিও মনের ছাইচাপা কষ্ট সামলে এ দিন কাকভোরেই উনুনে কেটলি বসিয়ে শিবেদা বললেন, ‘‘ফুটবল ছাড়তে পারব না। তাই খেলা দেখব। সবাই ভাল দল। সকলের ভাল হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy