Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ঝুপ শব্দে কাঁপে বুক

একতলার বাসিন্দা বৃদ্ধা রেণুকা চক্রবর্তী মাস কয়েক হল নতুন ঘরে এসে উঠেছিলেন ছেলে, নাতির সঙ্গে। ইচ্ছে ছিল জীবনের শেষ প্রান্তে গঙ্গার কোলে থাকার। এক রাতেই সেই আহ্লাদ ভয়ে পরিণত হয়েছে।

এগোতে এগোতে এ ভাবেই দোরগোড়ায় হাজির হয়েছে গঙ্গা। খড়দহে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

এগোতে এগোতে এ ভাবেই দোরগোড়ায় হাজির হয়েছে গঙ্গা। খড়দহে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

বিতান ভট্টচার্য
খড়দহ শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৭ ১০:১০
Share: Save:

বাজারহাট, স্কুল, অফিস যেখানেই যেতে হয়, হাঁটু জল না ভেঙে উপায় নেই। তবু ভরা বর্ষায় নদীর শোভা অন্য রকম। ঘিঞ্জি পাড়া থেকে একটু সরে গঙ্গার ধারে বাড়ির স্বপ্ন তাই অনেকেরই। খড়দহের কুলীন পাড়ার প্রোমোটার রাজীব পোদ্দারও সে কথা ভেবেই বছর চারেক আগে চারতলা আবাসন বানিয়েছিলেন গঙ্গার ধারে। সব ক’টি ফ্ল্যাট গঙ্গামুখী। বিক্রি করেছেন আটটি ফ্ল্যাট। নিজেও তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। রবিবার রাত থেকে এই আবাসনের বাসিন্দাদের ঘুম ছুটেছে। গঙ্গার ধারে ইটের বাঁধের একটি অংশ তলিয়ে গিয়েছে গঙ্গায়। ভাঙনে হারিয়ে গিয়েছে আবাসনের সামনের চাতালের অর্ধেক। বাকিটা ঝুলছে।

একতলার বাসিন্দা বৃদ্ধা রেণুকা চক্রবর্তী মাস কয়েক হল নতুন ঘরে এসে উঠেছিলেন ছেলে, নাতির সঙ্গে। ইচ্ছে ছিল জীবনের শেষ প্রান্তে গঙ্গার কোলে থাকার। এক রাতেই সেই আহ্লাদ ভয়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘ঝুপ করে আওয়াজ হতেই কেঁপে উঠছে বুক।’’ শুধু রেণুকাদেবী নন, এই আবাসনের পাশেই বাড়ি দেবব্রত দাসের। তিনি জানান, বছর কয়েক আগেই লোহার খাঁচা চুরি হয়ে গিয়েছিল। চোরের দল শাবলের চাড়ে আলগা করে ইটও চুরি করে নিয়ে গিয়েছে রাতের অন্ধকারে। ২০১৫ সাল থেকে সরকারের বিভিন্ন দফতরে বাঁধ মেরামতির আর্জি জানিয়েছেন দেবব্রতবাবুরা। পর্যবেক্ষণ হয়েছে সেই আর্জির প্রেক্ষিতে। তবু কাজ হয়নি। এ দিনও ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করেন সংশ্লিষ্ট দফতরগুলির আধিকারিকেরা।

কোটালের জলে এমনিতেই গঙ্গা সংলগ্ন পানিহাটি, খড়দহ জলমগ্ন। জল থই থই বি টি রোড থেকে অলি-গলি সর্বত্র। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গা খড়দহের ২২ নম্বর ওয়ার্ডের এই ক্যাম্প ঘাট এলাকা। ব্রিটিশ আমলে এখানে সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। সেনা নৌকোও বাঁধা হতো ঘাটে। সেই থেকে নাম ক্যাম্প ঘাট। ক্যাম্প ঘাটের পাশেই বাবাজি ঘাট। ওই এলাকা পর্যন্ত অর্ধ চন্দ্রাকারে ভাঙন শুরু হয়েছে। এই বহুতল ছাড়াও নতুন করে দু’টি বহুতল তৈরি হচ্ছে এখানে। বাড়িও আছে দু’-তিনটি। সেগুলির মধ্যে খড়দহ থানার প্রাক্তন আইসি অশোক রায়ের বাড়িটি এখন কার্যত গঙ্গার মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থায়। পুরসভার পক্ষ থেকে সোমবার দুপুরে গঙ্গাপাড়ের এই আবাসনটিতে নোটিস দেওয়া হয়েছে অবিলম্বে ঘর ছেড়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য। বিকেলের মধ্যেই আবাসন ও সংলগ্ন বাড়ির সামনের বাঁধানো অংশে ফাটল আরও বড় হয়। সন্ধ্যায় ধস নামে দ্বিতীয় বার। ওই আবাসনের বাসিন্দা গৌর গোপাল পাল বলেন, ‘‘পুরসভা সরে যেতে বললেও রাতারাতি সরে যাব কোথায়? প্রশাসনের কর্তারা দেখে গিয়েছেন। আপাতত অন্তত ঠেকা দেওয়ার মতো কিছু ব্যবস্থা তো করুন। ততক্ষণ পর্যন্ত যদি টিকে থাকে আমাদের ঘর-বাড়ি।’’

কিন্তু গঙ্গার এই ভাঙন তো আচমকা নয়। পুরসভা কী করে অনুমতি দিল গঙ্গার এত কাছে বহুতল তৈরি করার? স্থানীয় কাউন্সিলর সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যেখানে সেনাদের ক্যাম্প ছিল, সেই জায়গাগুলি তো খাস জমি হওয়ার কথা। বাম আমলেই এগুলির চরিত্র বদলে নিজেদের লোকেদের মধ্যে বিক্রি-বাট্টা হয়েছিল। তা ছাড়া আমাদের কাছে নির্দিষ্ট করে কোনও নির্দেশও নেই যে গঙ্গা থেকে ঠিক কতটা দূরে ক’তলা বাড়ি তৈরি করার অনুমতি দেওয়া যায়। ফলে এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে এই সমস্যাগুলির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’’ তবে সোমবারই বিষয়টি নিয়ে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন পানিহাটির বিধায়ক তথা বিধানসভার মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষ। নির্মলবাবু বলেন, ‘‘আমি জানি ওই এলাকার বাসিন্দারা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’’

সে আশ্বাসে ভয় কাটে না বাসিন্দাদের। হাতে আর সময়ই বা কত? প্রশ্ন ঘুরছে মুখে মুখে। এ রাজ্যের তো অন্তত মালদহ-মুর্শিদাবাদের ভাঙনের অভিজ্ঞতা থেকে সচেতন হওয়ার কথা। বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ব্যবস্থা হওয়া পর্যন্ত থাকবে তো তাঁদের ঘর-বাড়ি? অনেকের মনে পড়ছে, ক’দিন আগেই যে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের আর এক পুরসভা গারুলিয়ার কাঙালি ঘাটে ছ’টি বাড়ি ভাঙনে তলিয়ে গিয়েছিল। বাসিন্দাদের আতঙ্ক, প্রশাসন তো তা আটকানোর ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। ভাঙন আটকাতে এ বার তৎপর হয়ে উঠবে তো প্রশাসন? শুধু সে আশ্বাসের মুখ চেয়েই এখন খড়দহের বাসিন্দারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

river erosion Khardaha খড়দহ
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE