Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘ছেলের ভাল নম্বর চাইলে বাড়িতে পড়তে পাঠান’

স্কুলের শিক্ষকের মুখে প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’ শুনে তাজ্জব বনে যান অভিভাবক। ছেলেকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে ভর্তি করেন কাছেই অন্য একটি স্কুলে। বাংলা-সহ সব বিষয়ে মাধ্যমিকে তাক লাগানো নম্বর পায় ছেলেটি। 

অলঙ্করণ তিয়াশা দাস।

অলঙ্করণ তিয়াশা দাস।

সীমান্ত মৈত্র
হাবড়া শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:১২
Share: Save:

স্কুলে প্রায় প্রতি বছরই প্রথম হত ছাত্রটি। পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ভাল ফল করার পরে হঠাৎ দেখা গেল, বাংলায় অস্বাভাবিক কম নম্বর পাচ্ছে। অথচ, অন্য বিষয়ে নম্বর ন’য়ের ঘরে। পর পর দু’টি পরীক্ষায় এ হেন ফল করে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিল ছাত্রটি। বাংলার শিক্ষক তাঁর বাবাকে ডেকে বলেন, ভাল নম্বর পেতে হলে তাঁর বাড়িতে যেন ছেলেকে পড়তে পাঠান। না হলে নম্বর ভাল হওয়ার আশা নেই।

স্কুলের শিক্ষকের মুখে প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’ শুনে তাজ্জব বনে যান অভিভাবক। ছেলেকে স্কুল ছাড়িয়ে নিয়ে ভর্তি করেন কাছেই অন্য একটি স্কুলে। বাংলা-সহ সব বিষয়ে মাধ্যমিকে তাক লাগানো নম্বর পায় ছেলেটি।

বাড়িতে পড়ানোর জন্য স্কুলের শিক্ষকদের কারও কারও এমন আচরণ অনেকেরই জানা। স্কুলের চাকরির পাশাপাশি প্রচুর সংখ্যায় প্রাইভেট টিউশন করেন অনেকেই। ওই শিক্ষকদের যুক্তি, তাঁদের কাছে পড়তে আগ্রহী ছেলেমেয়েরা। বাধ্য হয়ে তাঁরা পড়ান। অনেকের মতে, সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ করলে তাঁরা টিউশন ছে়ড়ে দেবেন।

বাম আমলে একবার স্কুলের শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন পড়ানো যাবে না বলে ফতোয়া জারি হয়েছিল। কেউ কেউ বাড়িতে পড়ানো ছেড়েছিলেন সে সময়ে। হাবড়ার এক শিক্ষক আবার সে সময়ে চাকরিই ছেড়েছিলেন। তাঁর কাছে প্রাইভেট টিউশন ছিল বেতনের থেকে অনেক বেশি লাভজনক! সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। চলতি বছর ১৮ মার্চ স্কুল শিক্ষা দফতর ফের এক নির্দেশে জানিয়েছে, স্কুলের শিক্ষকেরা স্কুলের বাইরে পড়াতে পারবেন না। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির তেমন হেলদোল হয়নি বলেই অভিযোগ। এ বার বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন গৃহশিক্ষকেরা। যাঁরা ছাত্র পড়িয়ে সংসার চালান। বারাসত মহকুমার গৃহশিক্ষকেরা ইতিমধ্যেই জোট বেঁধেছেন।

স্কুলের মাস্টারমশাই-দিদিমণিদের গৃহশিক্ষকতা বন্ধে সরকারি নির্দেশ

সম্প্রতি প্রাইভেট টিউটর অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের বারাসত মহকুমা সংগঠনের তরফে হাবড়ায় সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে কয়েকশো গৃহশিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ওই সভা থেকেই দাবি তোলা হয়েছে, এখন থেকে স্কুল শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা বন্ধ করতে জোরদার আন্দোলন শুরু করা হবে। সংগঠনের সহ সভাপতি শুভ্র দাস বলেন, ‘‘১৮ মার্চ শিক্ষা দফতরের নির্দেশের পরেও স্কুল শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ হয়নি। এই সব শিক্ষকেরা চাকরি বাদে বাড়তি আয়ের জন্য সরকারকে রাজস্বও দেন না।’’ শুভ্র জানান, শীঘ্রই সংগঠনের তরফে স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে সরকারি নির্দেশের কপি নিয়ে যাওয়া হবে। তাঁদের বলা হবে, স্কুলের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করতে যেন তৎপর হন।

সংগঠন সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনায় গৃহশিক্ষকের সংখ্যা সব থেকে বেশি বারাসত মহকুমায়। নির্দিষ্ট করে সংখ্যাটা বলা না গেলেও কয়েক হাজার তো বটেই। মহকুমার সমস্ত গৃহশিক্ষকদের সঙ্গে সংগঠনের তরফে যোগাযোগ করার কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই সংঠগনের ছাতার তলায় এসেছেন প্রায় তিন হাজার গৃহশিক্ষক।

কয়েক মাস আগে সংগঠনের রাজ্য কমিটির তরফে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের কাছে স্মারকলিপিও দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্কুল শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধের দাবি করা হয়েছিন। বারাসত সংগঠনের তরফে মহকুমার কোন কোন শিক্ষকেরা প্রাইভেট পড়ান, তার তালিকাও দেওয়া হয়েছিল।

শুভ্র বলেন, ‘‘স্কুলে ঠিক মতো লেখাপড়া না হওয়া, এবং বিজ্ঞান বিষয়ে প্রজেক্ট তৈরি, প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়ার ভয় দেখিয়েও কোনও কোনও শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের তাঁর কাছে পড়তে বাধ্য করেন।’’ তবে ভাল ও দক্ষ শিক্ষকদের কাছে কিছু পড়ুয়া নিজেদের আগ্রহে পড়তে চায় বলেও মনে করেন তিনি। অনেকে কম বেতনে বা টাকা না নিয়েও স্কুলের বাইরে ছাত্রদের সহযোগিতা করেন। তবে সেই সংখ্যা নেহাতই কম— দাবি শুভ্রর।

কেন প্রাইভেট টিউশন করছেন? কয়েক জন শিক্ষকের সাফাই, ‘‘আমরা তো পড়াতে চাই না। তবে ছাত্র এবং অভিভাবকেরা অনুরোধ ফেলতে পারি না। তা ছাড়া, এখন তো অনেকেই চাকরির স্কুলে পাশাপাশি গৃহশিক্ষকের কাজ করছেন। সরকার তো কিছু বলছে না। তা হলে আমরা কেন প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করব?’’

প্রসঙ্গত, দীর্ঘ দিন ধরে কোচবিহারে স্কুল শিক্ষকদের টিউশন বন্ধের দাবিতে আন্দোলন চলছে। মাঝে স্কুল শিক্ষা দফতর একটু কড়া মনোভাব নেওয়ায় অনেকেই টিউশন বন্ধ করে দেন। পরে অবশ্য অভিভাবকদের একটি অংশের তরফ থেকে পাল্টা আন্দোলন শুরু হয়। ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাইভেট টিউটর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের কোচবিহার জেলা কমিটির সভাপতি অমিতাভ কর বলেন, “সরকারি নির্দেশ সকলকে মেনে চলতে হবে। ’’

তথ্য সহায়তা: নমিতেশ ঘোষ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teacher Private Tuition Notice
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE