Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ত্রাসের দেশে চলে ‘ভাইয়া’রই কানুন

এলাকার এক প্রোমোটার জানালেন, শিবুর অত্যাচারে তাঁদের নাভিশ্বাস উঠেছে। জমি কেনার সময় থেকেই শুরু হয় শিবুর তোলাবাজি। জমির মালিক এবং প্রোমোটার, দু’পক্ষকেই টাকা দিতে হয়।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:০৩
Share: Save:

অর্থবান প্রোমোটারই হোন বা ফুটপাথের দরিদ্র আনাজ বিক্রেতা— এখানে নিস্তার নেই কারও। ব্যবসা করতে হলে তোলা না দিয়ে তার হাত থেকে মুক্তি নেই।

সে ‘ভাইয়া’। নাম একটা আছে বটে, কিন্তু আট থেকে আশি— সকলেই তাকে জানে ‘ভাইয়া’ বলে। এলাকার বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘দেবতার মন্দিরে যেমন নৈবেদ্য দিতে হয়, তেমনই ভাইয়ার পায়ে প্রণামী না দিলে এলাকায় ব্যবসা করা যায় না।’’

এলাকা মানে ব্যারাকপুরের মণিরামপুর, সদরবাজার, নয়াবস্তি। আর ‘ভাইয়া’ বলে সকলে যাকে চেনেন, তার নাম শিবু যাদব। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শিবুর নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। এলাকার কোথাও বাড়ি বিক্রি বা তৈরি হলে সেই বাহিনীর লোকজন সেখানে ‘ভাইয়া’র ফরমান পৌঁছে দেয়। তার কাছে ‘নজরানা’ পৌঁছে গেলে বাকিটা জলের মতোই সহজ।

আর ‘ভাইয়া’র ফরমান না মানলে?

সে প্রশ্নের উত্তর যাঁরা জানেন, তাঁরা কেউই মুখ খুলতে চান না। কারণ, তাঁদের তার মূল্য চোকাতে হয়েছে বিস্তর। সোমবার রাতে সদরবাজারে গুলিবিদ্ধ হন এলাকার মাছ ব্যবসায়ী শেখ চাঁদু। তিনি বেরিয়েছিলেন ওষুধ কিনতে। তখন রাস্তায় পাড়ার যুবকদের সঙ্গে বচসা বেধেছিল শিবু যাদবের দলবলের। অভিযোগ, সেই সময়ে আচমকাই গুলি চালায় তারা। যা গিয়ে লাগে শেখ চাঁদুর গায়ে।

রোজ বিকেলে রাস্তার ধারে তেলেভাজার দোকান দেন বিকাশ রাম (নাম পরিবর্তিত)। বছর দুই আগে শুরু করেছিলেন সেই ব্যবসা। চালু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই দোকান বেশ জমে উঠেছিল। বিকাশ বলেন, ‘‘এক রাতে দোকান বন্ধ করার সময়ে তিনটে বাইকে জনা ছয় যুবক এসে বলল, ‘ভাইয়া পাঠিয়েছে। এখানে দোকান দিলে কাল থেকে রোজ ১০০ টাকা করে দিতে হবে।’ আমি ভাইয়ার নাম জানতাম। ওদের হাতে-পায়ে ধরতে ৫০ টাকায় রফা হল। এক বছর পরে ফের ওরা শাসিয়ে তা ১০০ টাকা করে।’’

সোমবার রাতে গুলি চলার পরে মঙ্গলবার দোকানপাট বন্ধ রেখেছিলেন এলাকার ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অভিযোগ, কোথাও দিনের হিসেব, কোথাও হপ্তা, কোথাও আবার মাসোহারার ব্যবস্থা রয়েছে শিবুর। তার দলবলের দাপটে এলাকায় কারবার চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে।

এলাকার এক প্রোমোটার জানালেন, শিবুর অত্যাচারে তাঁদের নাভিশ্বাস উঠেছে। জমি কেনার সময় থেকেই শুরু হয় শিবুর তোলাবাজি। জমির মালিক এবং প্রোমোটার, দু’পক্ষকেই টাকা দিতে হয়। যাঁরা তা দিতে চান না, তাঁদের ডেকে আনা হয় নয়াবস্তির একটি ক্লাবঘরে। সেখানে ‘বুঝিয়ে’ বলা হয়, শিবুর অবাধ্য হলে পরিণাম কী হতে পারে। ওই ক্লাবঘর থেকেই রাজ্যপাট নিয়ন্ত্রণ করে শিবু।

পুলিশে অভিযোগ করেননি কেন?

ওই প্রোমোটার বলেন, ‘‘থানা-পুলিশ করব কী! তা হলে তো প্রাণেই মেরে দেবে।’’

এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শিবুর একটি দল এলাকায় নজরদারি চালায়। অন্য দলটি চালায় সিন্ডিকেটের কারবার। প্রোমোটারই হোন বা সাধারণ বাসিন্দা, বাড়ি করতে হলে ইমারতি দ্রব্য নিতে হবে শিবুর সিন্ডিকেট থেকেই। কেউ নিজে থেকে বালি, স্টোন চিপ্‌স কিনতে চাইলে তাতে ‘ভাইয়া’র লোকেরা যে অখুশি হয়, তা নয়। তবে তার জন্যও তোলাও দিতে হয় তাদের। আর শিবুর সিন্ডিকেট থেকে জিনিসপত্র নিতে হলে মেনে নিতে হবে তাদের দাম এবং তাদের মাপ। সেই দাম বাজারদরের অন্তত দেড় গুণ বেশি। আর মাপ? বাজারের মাপের প্রায় অর্ধেক।

প্রশ্ন একটাই। দিনের পর দিন শিবুর এমন কারবার চলছে কী করে? মোবাইল বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যায়নি শিবু যাদবের সঙ্গে। পুলিশ-প্রশাসন কোথায়? ব্যারাকপুর কমিশনারেটের ডেপুটি কমিশনার (জোন ১) কে কারনানের বক্তব্য, ‘‘শিবু এখন এলাকায় নেই বলেই আমরা জানি। আগে তো ওকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। তবে, এই মুহূর্তে শিবুর বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় কোনও অভিযোগ নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Barrackpore industrial area Extortion Shibu Yadav
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE