মেয়েরাই পথ দেখাচ্ছে এখন। —প্রতীকী চিত্র
নাচতে ভালবাসতেন সালমা। কিন্তু সেই নাচ-ই যে তাঁর কাল হবে, তা যখন বুঝলেন ততক্ষণে স্বরূপনগরের বিথারি গ্রাম থেকে মুম্বইয়ের যৌনপল্লিতে পাচার হয়ে গিয়েছেন। ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাঁর স্বামীই বিক্রি করে দিয়েছিলেন সালমাকে।
মেলায় গিয়েছিল সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ফুলবানু। প্রতিবেশী শেখ সওকত কাজের লোভ দেখিয়ে তাকে নিয়ে যায় দিল্লির এক হোটেলে। সেখানে তাকে ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয়। এক বছর পরে ফুলবানু যখন পালিয়ে গ্রামে ফেরে, তখন সে সন্তানসম্ভবা। বসিরহাট জেলা হাসপাতালে তার ছেলে হয়।
নবম শ্রেণির দুই ছাত্রী তহমিনা ও ফরিদাকে প্রতিবেশী দুই যুবক মছলন্দপুরে নিয়ে যায়। গাড়িতে বসিয়ে রেখে সরে পড়ে। বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার নাম করে চালক কিছু খাইয়ে অজ্ঞান করে তাদের নিয়ে যায় বিহারে। এক বছর পরে ফোন পেয়ে পুলিশ দুই ছাত্রীকে উদ্ধার করে।
হামিদা খাতুনের সঙ্গে ভেকুটিয়ার রেজ্জাকের বিয়ে হয়েছিল। হাওড়া স্টেশন দেখানোর নাম করে স্ত্রীকে নিয়ে তোলে আমদাবাদের হোটেলে। যৌনপল্লিতে ৭৫ হাজার টাকায় তাকে বিক্রি করা হয়। পুলিশ হামিদাকে পরে উদ্ধার করে।
গত দশ বছরে এ ভাবে স্বরূপনগর থেকে হারিয়ে গেছে অন্তত আড়াইশো মেয়ে। কেউ স্বামীর কথায়, কেউ সহপাঠী অথবা প্রতিবেশীর কথায় বিশ্বাস করে পাচার হয়ে গিয়েছে সুদূর মুম্বই, দিল্লি, আমদাবাদের যৌনপল্লিতে। তাঁদের কেউ কেউ পুলিশের তৎপরতায় ফিরে এসেছে। এখন সেলাই-সহ নানা কাজের মাধ্যমে স্বনির্ভর হয়ে উঠছে।
এই সব মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছে স্বরূপনগর পঞ্চায়েত সমিতি, ব্লক প্রশাসন এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ব্লক প্রশাসন ও পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে তাদের মাসে ১২ কিলো করে চাল, চাদর, কম্বল ইত্যাদি পোশাক এবং স্বাস্থ্য দফতরের পক্ষ থেকে বিনা ব্যয়ে চিকিৎসা, ওষুধ ও পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তফসিলি সংখ্যালঘুদের ঋণ থেকে চার জনকে ২৫ হাজার করে এবং তফসিলিদের ঋণ বাবদ এক জনকে এক লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছে। এ বার কন্যাশ্রীর টাকা পাওয়া মেয়েরা সামনের বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ঝুমা সাহা বলেন, “পঞ্চায়েত সমিতির চেষ্টায় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করার পরে সাত জনের হাতে দেড় লক্ষ টাকা তুলে দেওয়া হবে। এসভিএসকেপি ঋণের টাকায় মেয়েদের সেলাই মেশিন কিনে দেওয়া হলে তারা গ্রামের আরও কয়েক জন মহিলাকে নিয়ে স্বনির্ভর হতে পারবে।” স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সম্পাদক মহিদুল ইসলামের কথায়, “মেয়েদের অনেকেই সরকারি সাহায্য এবং কাজ পেয়ে পুরনো জীবন ভুলতে বসেছে।” তিনি জানালেন, এই মেয়েরাই এখন নাটকের দল করেছে, নারী ও শিশুপাচার বন্ধে সীমান্তবর্তী গ্রামে ঘুরে বাসিন্দাদের বোঝাচ্ছে। বিডিও এবং পুলিশের সাহায্য নিয়ে অল্পবয়সে মেয়েদের বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে তারা।
নিজেরা কী বলছে মেয়েরা?
কয়েকজনের কথায়, “আমরা তো মরেই গিয়েছিলাম। খারাপ কাজের পাশাপাশি মার খেতে হতো। খেতে দিত না। ঘর থেকে বাইরে বার হওয়ার উপায় ছিল না। ভাল করে একটু নিশ্বাসও নেওয়ার সময় মিলত না।” এই অসহনীয় অবস্থা থেকে ফিরে এসে জীবন ফিরে পেয়েছে বলেই মনে করছে তারা। এখন কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই তাদের লক্ষ্য। পাশাপাশি গ্রামের দুঃস্থ মহিলাদের জন্য কিছু করতে চায় তারা। এই মেয়েরাই পথ দেখাচ্ছে এখন। (সব নাম পরিবর্তিত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy