Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

স্থায়ী শিক্ষকই নেই স্কুলে

বনগাঁর সভাইপুর জুনিয়র হাইস্কুলের কথাই ধরা যাক। এক জন মাত্র অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই সামলাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্ব।

মরিয়া-উদ্যোগ: ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন সুজয় মণ্ডল। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

মরিয়া-উদ্যোগ: ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন সুজয় মণ্ডল। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:১৮
Share: Save:

সাগরের মৃত্যুঞ্জয়নগর বালিকা বিদ্যানিকেতন একা নয়, রাজ্যের নানা প্রান্তে এমন বহু স্কুল এক জন মাত্র শিক্ষকের ভরসায় চলছে বলে ক্রমে সামনে আসছে।

বনগাঁর সভাইপুর জুনিয়র হাইস্কুলের কথাই ধরা যাক। এক জন মাত্র অবসরপ্রাপ্ত মাস্টারমশাই সামলাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের দায়িত্ব। স্থানীয় আরও দুই যুবক বিনা পারিশ্রমিকে পড়াচ্ছেন। কিন্তু সামাল দেওয়া যাচ্ছে কই! কমছে পড়ুয়ার সংখ্যা। পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা হয় এখানে। গত বছর পড়ত ৮১ জন। এ বছর সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৩৪-এ। গত বছর সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত ৪২ জন। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পরে এখন পড়ুয়ার সংখ্যা ১৬। বাকিরা অন্য স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছে। সভাইপুর জুনিয়র হাইস্কুলের সঙ্গেই রয়েছে সভাইপুর এফপি স্কুল। গত বছর সেখানে পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ২৫৪ জন। ওই প্রাথমিক স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে পাশ করা পড়ুয়াদের মধ্যে এ বার মাত্র ৪ জন পড়ুয়া জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছে।

স্থানীয় মানুষের দাবি, শিক্ষকের অভাবে স্কুলে ঠিক মতো পড়াশোনা হয় না স্কুলে। অনেকে চতুর্থ শ্রেণির পরে ছেলেমেয়েদের অন্য স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সেই স্কুল।

শুরু থেকেই অবশ্য পুরো সময়ের শিক্ষক ছিলেন না স্কুলে। ২০১৫ সালে স্কুলটি তৈরি হয়। পরের বছর থেকে পড়াশোনা শুরু হয়। তিন জন অতিথি শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছিল। এক জন কাজে যোগ দেন অল্প কিছু দিনের জন্য। গ্রামের কিছু যুবক সে সময়ে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষ জানালেন, সে সময়ে প্রশাসন কথা দিয়েছিল, ক্রমে ক্রমে পুরো সময়ের শিক্ষক নিয়োগ করা হবে। কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি। কোনও মতে ঠেকা দিয়ে চলছে কাজ।

স্কুলের ঠিক পিছনেই থাকেন রাবেয়া মণ্ডল। তাঁর নাতি ইনাইতুল্লা এ বার অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে। নাতিকে তিনি প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের স্কুলে ভর্তি করেছেন। রাবেয়া বলেন, ‘‘বাড়ির পাশের স্কুলে লেখাপড়া হয় না। নাতির লেখাপড়ায় মন চলে যাচ্ছিল। তাই অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। যাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রয়োজনে একটা সাইকেল কিনে দেব ভাবছি।’’

স্কুলে শ্রেণিকক্ষেরও সমস্যা রয়েছে। তিনটি মাত্র ক্লাসরুম। পঞ্চম শ্রেণির পঠনপাঠন চালানো হচ্ছে পাশের একটি ফ্লাড সেন্টারে। শৌচাগার নেই। তবে মিড ডে মিল খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

অতিথি শিক্ষক শশাঙ্কশেখর দাস অবসর নিয়েছেন অন্য স্কুল থেকে। তারপরে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এই স্কুলের দায়িত্বে রয়েছেন। গাইঘাটার ঝাউডাঙা এলাকায় বাড়ি। প্রায় ২২ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে স্কুলে আসেন মাস্টারমশাই। রোজ যাতায়াতে খরচ হয় ৮০ টাকা। বাড়ির কাছের স্কুলেও তিনি অতিথি শিক্ষকের কাজ পেয়েছিলেন। কিন্তু সভাইপুরের স্কুলের হাল দেখে এখানেই কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।

শশাঙ্ক বলেন, ‘‘আমি না এলে স্কুলটা চালানো সম্ভব হত না। তাই কষ্ট হলেও এখানে আসছি।’’

স্থানীয় যুবক প্রিঙ্কর সরকার ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে এবং সুজয় মণ্ডল নামে আরও এক যুবক গত বছর পুজোর সময় থেকে স্কুলে বিনা বেতনে পড়াচ্ছেন। প্রিঙ্কর বলেন, ‘‘স্কুলকে বাঁচাতে আমরা পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এত করেও পড়ুয়াদের ধরে রাখতে পারছি না।’’

গ্রামবাসীরা চান, স্কুলে স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ করা হোক। তা হলে তাঁদের ছেলেমেয়েদের আর দূরে পাঠাতে হবে না। স্কুলে এখন কোনও পরিচালন সমিতি নেই। একটি কমিটি করা হয়েছে মাত্র। বনগাঁর বিডিও সঞ্জয় গুছাইত আছেন সেই কমিটিতে। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের সমস্যা মেটাতে গত এপ্রিল মাসেই স্কুল শিক্ষা দফতরকে জানানো হয়েছে।’’

বনগাঁ মহকুমার অতিরিক্ত জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক দিব্যেন্দু পাল সম্প্রতি দায়িত্বে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘‘খোঁজখবর নিয়ে দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ করা হবে। শিক্ষা দফতরকেও জানানো হচ্ছে।’’

সাগরের স্কুলের খবর জানাজানি হওয়ার পরে শিক্ষামন্ত্রী সেখানে দু’জন শিক্ষিকা পাঠানোর কথা জানিয়েছেন। সভাইপুরের স্কুলের দিকেও তাঁর নজর পড়ে কিনা, সে দিকেই তাকিয়ে আছেন সকলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teacher School West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE