—প্রতীকী ছবি।
পাচারকারীদের নাগাল এড়িয়ে কোনও ক্রমে বেঁচে ফেরা এক নাবালিকা পড়াশোনা করে বড় হওয়ার অঙ্গীকার করল শিশুদিবসেই। বাদুড়িয়া থানায় শিশুদিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানে দেখা হল দোয়েল নামে ওই কিশোরীর সঙ্গে। জানা গেল তার জীবনের ঘটনা। বাদুড়িয়ার এক গ্রামে বাড়ি মকবুল গাজি ও সায়রা বিবির। তাঁদের মেয়ে দোয়েল তখন (সকলের নাম পরিবর্তিত) সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে নাচত, নাটক করত, ছবিও আঁকত। বছর চোদ্দো বয়সেই পটু হয়ে উঠেছিল সেলাইয়ের কাজে। সুন্দর নকশা তুলতে পারত কাপড়ে।
হঠাৎই এক দুপুরে মেয়েটির চারপাশের সুন্দর এই জগৎ বদলে গেল। সে জানতে পারল, তার মতামতের কোনও তোয়াক্কা না করেই দাদারা বিয়ের ঠিক করেছে। এবং সেই দিনই বিয়ে। পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করবে না বলে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মেয়েটি। ছোটবেলায় বাবা হারানো নাবালিকার কথা সে দিন শোনেননি তার দাদারা। প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মা। কিন্তু মায়ের কথাতেও সেদিন গুরুত্ব দেয়নি কেউ। অবশেষে বিয়ে হয়ে যায় দোয়েলের।
দোয়েল ভেবেছিল, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শুরু করতে পারবে পড়াশোনা। ভর্তি হতে পারবে স্কুলে। কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা, তার থেকে বয়সে অন্তত বারো বছরের বড় স্বামীর কাজ ছিল প্রতি রাতে আকণ্ঠ মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে তাকে মারধর করা। প্রতিবাদ করলে পাল্টা শাশুড়ির হাতে মার খেতে হত কিশোরী বধূকে। স্বামী-শাশুড়ির হাতে মার খেয়ে, গালমন্দ শুনে কয়েক মাসের মধ্যেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল দোয়েল।
বিয়ের এক বছরের মাথায় এক দিন ভোরে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় সে। সামনে যে বাস পায় তাতেই উঠে পড়ে। বাসটি বারাসতে গিয়ে থামলে সেখানেই নামে। দাঁড়িয়ে ভাবছিল, এরপর কী করবে। এমন সময়ে এক মহিলা যেচে এসে আলাপ করে। সব শুনে তাকে নিজের ঝুপড়িতে থাকতে দেয়। দোয়েলের কথায়, দু’চার দিন পরে ওই মহিলা তাকে ভাল বেতনের কাজ পাইয়ে দেবে বলে কলকাতার গড়িয়ায় নিয়ে যায়। সেখানে এক ঝুপড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে উধাও হয়।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে দোয়েল দেখে, কয়েকটি ছেলে তার দিকে উৎসুক ভাবে তাকাচ্ছে। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ভয়ও দানা বাধছে তার বুকে। ওই সময়ে ফুটপাতে আনাজ নিয়ে বসা এক মহিলা তাকে ফিসফিস করে জানান, তাকে যে মহিলা নিয়ে এসেছে এবং দূরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে যে ছেলেরা, সকলেই নারীপাচারকারী চক্রের সঙ্গে যুক্ত। শোনামাত্র দৌড় লাগায় দোয়েল।
দোয়েল বলে, ‘‘সামনে ছিল যাদবপুর থানা। বিপদ বুঝে সে দিকে দৌড় লাগাই। পিছু নেয় ছেলের দল। থানার সামনে গিয়েই জ্ঞান হারাই আমি।’’ সে দিন পুলিশ তাকে উদ্ধার করে, সে সুস্থ হলে তার কাছে সব জেনে তাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
মা অবশ্য দাদাদের সংসারে আর থাকেননি। মেয়েকে নিয়ে অন্যত্র থাকেন তিনি। জেলা ‘সাম্য শ্রমজীবী সমিতি’র সম্পাদক মনিকা সরকার এখন দোয়েলকে নানা ভাবে সাহায্য করেন। তাঁর সংস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি রোজগারও করে দোয়েল। কাপড়ে নকশা তোলার কাজ করে। তাতেই কোনও রকমে চলে যায় মা-মায়ের। মনিকা বলেন, ‘‘দোয়েল সাহসী, লড়াকু। না হলে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েও ফিরতে পারত না। ওকে সেলাইয়ের কাজে যুক্ত করা হয়েছে। সংসার চালানোর জন্য চাল-গমের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ওকে এ বারে আমরা মুক্ত বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে ভর্তি করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy