প্রতীকী ছবি।
সুনসান পড়ে আছে বিশাল মাঠটা। শ্রাবণের ধারা ঝরে পড়ে। কিন্তু কাদা মাঠে বল নিয়ে ছেলের দল আর দাপাদাপি করে না। নেহাত প্রয়োজন না পড়লে কেউ ও পথ মাড়ায়ও না।
২০১৫ সালের অগস্ট মাসের একটা ঘটনা গ্রামের মাঠটার প্রতিই যেন মন বিষিয়ে দিয়েছে গাঁয়ের মানুষের। শ্রাবণের এক সকালে বাজ পড়ে ওই মাঠে খেলতে গিয়ে চার চারটি তাজা প্রাণ চলে গিয়েছিল।
এখনও আকাশ কালো করে এলে গ্রামের মানুষের বুক কাঁপে। আর কোনও প্রাণ দিয়ে মাসুল গুণতে হবে না তো, প্রশ্ন ঘোরে মনে। আর ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত শুরু হলেই লোকজন ঘরে খিল এঁটে বসে থাকেন। বাইরে বেরোনোর বুকের পাটা নেই কারও।
আকাশে আলোর ঝলকানি, পরের মুহূর্তে কান ফাটা আওয়াজ আর তারপরেই চিৎকার করে কান্না, শোরগোলের শব্দ এখনও কানে ভাসে বিসানি মুন্ডার। সন্দেশখালি ১ ব্লকের ন্যাজাটের দক্ষিণ আখড়াতলা অর্জুন সর্দারপাড়ার বিসানি সে দিনের কথা বলতে গিয়ে এখনও চোখ মোছেন। সকাল তখন ১১টা হবে। বিসানি বলেন, ‘‘প্রবল শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে দেখি মাঠে পড়ে ছটফট করছে কয়েকটা ছেলে।’’ বাজ পড়ে নারায়ণ মুন্ডা, মিঠুন মুন্ডা, শুভজিৎ সর্দার ওরফে বাপি এবং অমিত সর্দারের প্রাণ গিয়েছিল সে দিন। বিসানি বলেন, ‘‘ছুটে বেরিয়ে মাঠে গিয়ে দেখি, ১০-১২টা ছেলে এ দিক ও দিক ছিটকে পড়ে আছে। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করছিল কেউ কেউ। কয়েকজনের শরীর নিথর।’’ গ্রামের লোকজন জানালেন, যাঁরা সে দিন মারা গিয়েছিল, সেই ছেলেদের কারও গায়ে আঁচড়ের দাগটুকু ছিল না। শুধু দেহ শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
অমিয় গায়েন, নিতাই দাস, সূর্যকান্ত সর্দাররা জানালেন, চোখের সামনে এখনও চারটে ছেলের মুখ ভাসে। বাজ পড়া যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা বিলক্ষণ বোঝেন গ্রামের মানুষ। তাই ইদানীং যখন বাজ পড়ার ঘটনা আরও বাড়ছে, তখন আতঙ্ক চেপে বসেছে এলাকার মানুষজনের মনে। অমিয়র কথায়, ‘‘বৃষ্টি হলে বাইরে বেরোই না কেউ। ওই ইটভাটার মাঠে কেউ ফুটবলও খেলে না। পারলে লোকে ওই পথ এড়িয়ে চলে।’’ রান্না করছিলেন শুভজিতের বাবা নিধিরাম সর্দার। পুরনো কথা উঠতেই চোখ ভরে এল জলে। বললেন, ‘‘ছেলেটা বলে গিয়েছিল, খেলা শেষে বাড়ি ফিরে ভাত খাবে। ওর মা মারা যাওয়ার পরে আমিই ভাত রেঁধে খাওয়াই। সে দিনও রান্না করে রেখেছিলাম। অথচ ভাতের থালা পড়ে থাকল। ছেলে ফিরল না।’’
নিধিরাম ছাড়াও সে দিনের ঘটনায় সন্তান হারিয়েছেন রজনী মুন্ডা, বিভীষণ সর্দার এবং সূর্যকান্ত সর্দার। তাঁদের কথায়, ‘‘চাষবাস করে খাই। আগে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে আনন্দে ঘর থেকে বেরিয়ে মাঠে চলে যেতাম। ভিজে ভিজেই কাজ করতাম। এখন বৃষ্টি এলেই বুক কাঁপে। কারও আবার বিপদ-আপদ না ঘটে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy