Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

ছেলেকে মোটর বাইক নিয়ে যেতে নিষেধ করেছিলেন বাবা

মাকে ভাত বাড়তে বলে বেরিয়েছিল ছেলে। স্কুলে যাবে, আর আসবে। অ্যাডমিট কার্ড নিতে কত ক্ষণ আর লাগার কথা। কথা রাখতে পারেনি ছেলে। বাড়ি ফেরা হয়নি তার। অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে মসিউর রহমান ওরফে বাপ্পা। মারা গিয়েছে তার বন্ধু বাবুসোনা খান। জখম আর এক বন্ধু মোস্তাক আহমেদ গাজি আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিত্‌সাধীন কলকাতার হাসপাতালে।

শোকস্তব্ধ গ্রাম। বুধবার নির্মল বসুর তোলা ছবি।

শোকস্তব্ধ গ্রাম। বুধবার নির্মল বসুর তোলা ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:১৫
Share: Save:

মাকে ভাত বাড়তে বলে বেরিয়েছিল ছেলে। স্কুলে যাবে, আর আসবে। অ্যাডমিট কার্ড নিতে কত ক্ষণ আর লাগার কথা।

কথা রাখতে পারেনি ছেলে। বাড়ি ফেরা হয়নি তার। অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে মসিউর রহমান ওরফে বাপ্পা। মারা গিয়েছে তার বন্ধু বাবুসোনা খান। জখম আর এক বন্ধু মোস্তাক আহমেদ গাজি আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিত্‌সাধীন কলকাতার হাসপাতালে।

মঙ্গলবার বসিরহাটের আমতলার কাছে টাকি রোডে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে মসিউরের বাইকে। ছিটকে পড়ে তিন কিশোর। উল্টো দিক থেকে একটি ইট-বোঝাই ট্রাক তাদের চাপা দেয়।

সকলেই বড় জিরাকপুর তরুণ সঙ্ঘ হাইস্কুলের ছাত্র। ঘটনার পরে বুধবার ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় ওই স্কুলে। আশপাশের জিরাকপুর অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল এবং লক্ষ্মণকাটি প্রাথমিক স্কুলেও এ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। শোকের পরিবেশ নেমে এসেছে বসিরহাটের গোঠরা পঞ্চায়েতের লক্ষ্মণকাটি গ্রামে। এখানেই বাড়ি মসিউর-বাবুসোনাদের।

এ দিন দুপুরে কথা হচ্ছিল মসিউরের বাবা মিজানুরের সঙ্গে। তিনি ছেলেকে মোটর বাইক নিয়ে যেতে বারণ করেছিলেন। কাছেই স্কুল। বলেছিলেন, সাইকেল নিয়ে যা। কথা শোনেনি ছেলে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার পরেও ছেলে বাড়ি ফেরেনি। হঠাত্‌ই প্রতিবেশীরা খবর দেন, কী দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে।

ছেলের কথা বলতে গিয়ে বার বারই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মা সুফিয়া বিবি। থেকে থেকে জ্ঞান হারাচ্ছেন। আর জ্ঞান ফিরলেই বলছেন, “ভাত বাড়তে বলে ছেলেটা যে এমন ভাবে আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে, তা যদি বুঝতে পারতাম তা হলে কিছুতেই ওকে মোটর বাইক নিয়ে যেতে দিতাম না। এখন ওকে বাদ দিয়ে কি করে আমাদের মুখে কি আর ভাত উঠবে!” সদ্য সন্তানহারা মায়ের কান্না দেখে চোখের জল চেপে রাখতে পারছেন না প্রতিবেশী মহিলা-পুরুষরাও।

গ্রামে গিয়ে জানা গেল, মঙ্গলবার রাত থেকেই এলাকার বেশির ভাগ বাড়িতে কার্যত হাঁড়ি চড়েনি। মৃত দুই কিশোরের বাড়িতে রাত থেকেই শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ভিড় করছেন। সকলেরই মুখেই একটা কথা, “বড় ভাল, শান্ত স্বভাবের ছেলে ছিল ওরা। কেন যে মোটর বাইক নিয়ে দন্ডিরহাট গিয়েছিল জামা-প্যান্ট আনতে। না হলে হয় তো এ ভাবে অকালে চলে যেতে হত না ওদের।”

স্কুলের প্রথা মতো মঙ্গলবার দুপুরে মাধ্যমিক ছাত্রছাত্রীদের হাতে ফুল, পেন, কেক এবং আ্যাডমিট কার্ড তুলে দিয়ে বিদায় সম্বর্ধনা জানানো হয়। স্কুলের শিক্ষক মিহির বিশ্বাস, জগন্নাথ দাস, জাকির হোসেন বলেন, “পরীক্ষার আগে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে মন দিতে বারণ করা হয়েছিল। অকারণ রাস্তার ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট না করতে পরামর্শ দেওয়া হয়। তারপরে এমন কাণ্ড হবে ভাবাই যাচ্ছে না। সকলেই অত্যন্ত মর্মাহত।”

দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় মসিউরের। কলকাতার পথে খোলাপোতার কাছে মারা যায় বাবুসোনা। আর পাঠানো হয় কলকাতায়।

মঙ্গলবার স্কুল ছুটির পরে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভলিবল খেলা হচ্ছিল। দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রধান শিক্ষক সজলকুমার দে-সহ অন্যান্য শিক্ষকেরা ছোটেন বসিরহাট জেলা হাসপাতালে। এ দিন সকালেও শিক্ষক-শিক্ষিকারা যান মৃত ও আহত ছাত্রের বাড়িতে।

লক্ষ্মণকাটি গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা সেলিমের দোতলা বাড়ির সামনে তখন উপচে পড়েছে ভিড়। কিছু দিন আগেই ছেলে বাবুসোনার আবদার রাখতে মোটর বাইক কিনে দিয়েছিলেন পেশায় অটোরিকশা চালক সেলিম। কিন্তু নতুন বাইক চালানো শিখে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় মা সেরিনা মোটর বাইক চেন দিয়ে আটকে তালা দিয়ে রেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও বন্ধুর মোটর বাইকে সওয়ার হয়ে ছেলের মৃত্যু আটকানো গেল না। বারে বারে কান্নায় ভেঙে পড়ে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন সেলিম ও তাঁর স্ত্রী। প্রতিবেশী বাবলু সাহাজি, ফিরোজ বৈদ্য, আব্দুর রজ্জাক মণ্ডলরা বলেন, “একেই বলে নিয়তি। স্কুলে সাইকেলে যেতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত ছেলেরা মোটর বাইক নিয়ে গেল। এমন মর্মান্তিক ঘটনার পরে রাত থেকে প্রায় কারও চোখে ঘুম নেই। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে কাল থেকে প্রায় রান্না চাপেনি।”

একটু দূরেই পূর্বপাড়ার একতলা বাড়িটার সামনেও তখন প্রচুর লোকের ভিড়। মসিউর এবং হাবিবুর দুই ভাই। দু’জনেরই এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। দাদার মৃত্যুতে ভেঙে পড়া হাবিবুর বলে, “আমরা সকলে এক সঙ্গে খেতাম। দাদাটা যে কেন মা-বাবার বারণ না শুনে জোর করে বাইক নিয়ে বের হল! দাদাই যখন পরীক্ষা দিতে পারল না, তখন আমিও পরীক্ষা দেব না।” কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে আসায় কোনও মতে চোখের জল সামলে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেল হাবিবুর। মিজানুর বলেন, “ছেলেটার বড় শখ ছিল পড়াশোনার। সাইকেলের দোকান সামলানোর পরে মুরগির মাংস বিক্রি করত। জমির কাজ দেখাশোনার পরে যেটুকু সময় পেত, বই-খাতা নিয়ে বসত।”

স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রামপ্রসাদ ভট্টাচার্য বলেন, “ওই তিন ছাত্রই পড়াশোনায় ভাল। দুই ছাত্রের মৃত্যুতে আমরা শোকগ্রস্ত। তবে এটা ঠিক যে, গাড়ি কিনে অনেকেই বাড়ির সামনে রাস্তার উপর রাখা এবং রাস্তা আটকে ইমারতি ব্যবসার জন্য অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। প্রশাসনের বিষয়টা ভাবা দরকার।’’

মৃত ছাত্রদের সহপাঠী বাবু মল্লিক বলে, “আমাদের সাইকেলে স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল। সেই মতো তৈরি হচ্ছিলাম। হঠাত্‌ ফোন পেয়ে মসিউর মোটর বাইক নেওয়ায় ওদের সঙ্গে আমার আর যাওয়া হল না। স্কুল থেকে বেরিয়েই ফোন জানতে পারি, দুর্ঘটনা ঘটেছে।” ছেলেটি জানায়, যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই রাস্তার পাশে ইমারতি সরঞ্জাম পড়ে ছিল।

এ দিনই বেলার দিকে দুই ছাত্রের দেহ কবরস্থ করা হয়। গ্রামের একটি মাঠে শোকগ্রস্থ কয়েকশো মানুষের ভিড় দেখে একজনকে বলতে শোনা গেল, “এমন দুর্ঘটনার পরেও কেমন প্রশাসনের নাকের ডগায় রমরমিয়ে রাস্তার দু’পাশে লরি দাঁড় করিয়ে ইট-বালি-পাথরের ব্যবসা চলছে। পথচারী এবং গাড়ি চলাচলের অসুবিধা করে রাস্তা আটকে লরি দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। লাইসেন্স-বিহীন গাড়ি বেড়েই চলেছে। অথচ পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা স্রেফ দর্শকের।”

এ দিন সন্ধ্যায় মৃত ও আহত ছাত্রদের বাড়িতে আসেন সাংসদ ইদ্রিশ আলি। আহত ছাত্রের চিকিত্‌সার যাবতীয় খরচ বহনের আশ্বাস দেন তিনি। ছেলেটিকে এনআরএসে ভর্তির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছিল। টেলিফোনে হাসপাতাল সুপারের সঙ্গে কথাও বলেন ইদ্রিশ। পরে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হয় মোস্তাককে। রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, ইমারতি দ্রব্য ফেলে রেখে ব্যবসা চালানোর অভিযোগও শোনেন ইদ্রিশ। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

southbengal accident death basirhat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE