এই মন্দিরকে ঘিরেই পাণ্ডবদের নিয়ে জনশ্রুতি। —নিজস্ব চিত্র।
পুরাণ বলছে, এ বঙ্গ ‘পাণ্ডববর্জিত’। অর্থাৎ, এখানে কখনও পাণ্ডবদের পা পড়েনি।
কিন্তু, বাঁধা ছাঁদের বাইরে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা-কল্পনার মধ্যে দিয়ে যে গল্পকথা এগিয়ে চলে তাতে অনেক অঘটনও কখন যেন সত্যি হয়ে ওঠে।
পাণ্ডবেশ্বরে এসে পঞ্চপাণ্ডব ও মাতা কুন্তীর ছ’টি শিবলিঙ্গ স্থাপনও তেমনই এক ‘সত্যি’। কবে, কখন এই লোকশ্রুতি চলতে শুরু করেছিল, আজ আর তার হদিস মেলে না। কোলিয়ারিতে ঘেরা এই অঞ্চলে অবশ্য মুখে মুখে ফেরে সেই কাহিনি। তবে শুধু এই কল্পকথা নয়, বৃটিশ আমলের কীর্তি থেকে আধুনিক খনি প্রকল্প পাণ্ডবেশ্বরে মিলেমিশে রয়েছে সব কিছুই।
এখনকার পাণ্ডবেশ্বর আসলে পাণ্ডবেশ্বর, ডালুরবাঁধ ও ফুলবাগান এই তিন এলাকা নিয়ে গঠিত। তার মধ্যে পাণ্ডবেশ্বর এলাকাটি আবার আগে বৈদ্যনাথপুর বলে পরিচিত ছিল। এখন সেই জায়গা বৈদ্যনাথপুর ও পাণ্ডবেশ্বর গ্রাম দুই এলাকায় বিভক্ত। এলাকার প্রবীণদের কাছে জানা যায়, যখন রেল স্টেশন তৈরি হয়, পাণ্ডব মুনির আশ্রম থাকার সুবাদে এখানকার স্টেশনের নাম রাখা হয় পাণ্ডবেশ্বর। সেই থেকে গোটা এলাকা পাণ্ডবেশ্বর নামেই পরিচিত হয়। পাণ্ডবেশ্বর গ্রাম থেকে কেন্দ্রা, ডালুরবাঁধ, জোয়ালভাঙা, গোগলা, গোবিন্দপুর পর্যন্ত প্রসারিত এই শহর।
বৃটিশ আমলের শেষ দিকে পাণ্ডবেশ্বরের ডালুরবাঁধ ও বিলপাহাড়ি মৌজায় একটি এবং লাগোয়া জামশোল মৌজায় একটি এয়ারবেস চালু হয়। তার অনেক আগেই অবশ্য লাগোয়া এলাকা রানিগঞ্জে প্রথম কয়লা খনি চালু হয়ে গিয়েছে। সেই সূত্র ধরে একে একে জামুড়িয়া এবং পাণ্ডবেশ্বরেও কয়লা খনন শুরু হয়। সেই সময়ে খনি ছিল বেসরকারি হাতে। শ্রীপাণ্ডবেশ্বর খনি (যা এখন সাউথ শ্যামলা নামে পরিচিত) টাটার, বিলডাঙা ও মান্দারবনি বিড়লার, নতুনডাঙা জেএন মুখোপাধ্যায়ের হাতে ছিল। এ ছাড়াও অগ্রবাল, ভালোটিয়া-সহ কিছু গোষ্ঠীর হাতে কোলিয়ারি চালু হয় পাণ্ডবেশ্বরে। ১৯৭৩ সালে খনি রাষ্ট্রায়ত্তকরণ হয়।
জনশ্রুতি, অজ্ঞাতবাসের সময়ে মাতা কুন্তীকে নিয়ে এক সময়ে অজয় নদের ধারে আশ্রয় নিয়েছিলেন পাঁচ ভাই। পাশাপাশি একটি করে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করে পুজো করতেন তাঁরা। অজয়ের পাশে তা-ই এখন পাণ্ডব মুনির আশ্রম হিসেবে পরিচিত। শিব মন্দিরের পিছনের এই কাহিনির জন্যই এলাকা পাণ্ডবেশ্বর হিসেবে খ্যাত বলে জানান জেলা পরিষদের প্রাক্তন সদস্য তথা পাণ্ডবেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা জীতেন চট্টোপাধ্যায়। আরও কথিত রয়েছে, অজয়ের ও পারে প্রতি সপ্তাহে এক রাক্ষস আসত। প্রতি পরিবারকে পালা করে এক সদস্যকে তার হাতে তুলে দিতে হত আহার হিসেবে। কুন্তীর নির্দেশ মতো ও পারে গিয়ে সেই রাক্ষসকে বধ করেন ভীম। সেই থেকে সেই এলাকা ভীমগড়া বলে পরিচিত। তা এখন বীরভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত।
তবে কবে থেকে এই সব জনশ্রুতি শুরু হয়, এলাকার প্রবীণেরাও সে নিয়ে ধন্দে। এটুকু শোনা যায়, অষ্টাদশ শতকে ঘনশ্যাম নামে এক সাধক এখানে সিদ্ধিলাভ করেন। সেই থেকেই শিব মন্দিরগুলির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই মন্দিরগুলির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মহন্ত পাণ্ডবনাথের নাম থেকে পাণ্ডবেশ্বর নামটি এসেছে বলেও ঐতিহাসিকদের একাংশের অনুমান।
প্রায় চার দশক আগে এলাকার তৎকালীন সাংসদ নারায়ণ চৌধুরীর চেষ্টায় রাজ্য সরকার অজয়ের বালিতে খননকাজ শুরু করে। সেই সময়ে বেশ কিছু মূর্তি ও মুদ্রার সন্ধান মেলে। তার মধ্যে নীল সরস্বতী ও হনুমান মূর্তি পাণ্ডবদের মন্দিরকে ঘিরে তৈরি হওয়া নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের মঠেই আছে। বংশ পরম্পরায় ওই মন্দিরের সেবায়েত রামনগর গ্রামের চক্রবর্তী পরিবার। তাঁদের কাছ থেকে উখড়ার জমিদার বাড়ি ছ’আনা মালিকানা কিনে উখড়ার নিম্বার্ক সম্প্রদায় বা মহন্তস্থল ট্রাস্টি বোর্ডকে দেয়। সেই থেকে প্রথাগত পুজোপাঠ চক্রবর্তী পরিবার করলেও মন্দিরের অন্য কাজ নিম্বার্কেরাই করেন।
গোটা এলাকায় কর্মসংস্থানের প্রধান উপায় এই কয়লা খনি। রেল-সহ নানা যোগাযোগ ব্যবস্থাও এখানে গড়ে উঠেছিল খনিকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু সেই খনিতেই কর্মসংস্থানে এখন ভাটার টান। নানা কোলিয়ারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্তকরণের সময়ে পাণ্ডবেশ্বর অঞ্চলে খনিতে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় আঠেরো হাজার। কিন্তু এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজারে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পাণ্ডবেশ্বরকে তুলে ধরার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। পাণ্ডবেশ্বর গ্রামের বাসিন্দা, পেশায় শিক্ষক সুকুমার রুইদাসের মতে, “সরকারি উদ্যোগে এ সব নিয়ে গবেষণা হলে অতীত ঐতিহ্যে পাণ্ডবেশ্বর আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।”
নানা কাহিনির মাঝেই এখানে বাস মানুষের। তবে তার সঙ্গে তাঁদের সঙ্গী নানা নাগরিক সমস্যাও।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy