Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বাইরের লোক এসেই বলে, এত্তা জঞ্জাল!

শহরের কোথাও ছ’ফলা, কোথাও ত্রিফলা বাতি লেগেছে। একসময়ের আলো-আঁধারি শহরটার গলিঘুঁজিও এখন বেশ ঝলমলে। কিন্তু তারপরেও রাস্তাঘাটে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছেন না মানুষ। কারণ বড় রাস্তা থেকে অলিগলি, সর্বত্র উপচে পড়ছে জঞ্জাল। খোলা ভ্যাটের দুর্গন্ধে সুস্থ মানুষেরও অসুস্থ হওয়ার জোগাড়। তবে সাফাই কর্মীরা যে আবর্জনা পরিষ্কার করেন না এমনটা নয়, বরং রোজই নতুন নতুন ভ্যাট গজিয়ে ওঠায় বিব্রত তাঁরাও।

বর্ধমান-কালনা রোডে উপচে গিয়েছে আবর্জনা।

বর্ধমান-কালনা রোডে উপচে গিয়েছে আবর্জনা।

রানা সেনগুপ্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৪১
Share: Save:

শহরের কোথাও ছ’ফলা, কোথাও ত্রিফলা বাতি লেগেছে। একসময়ের আলো-আঁধারি শহরটার গলিঘুঁজিও এখন বেশ ঝলমলে। কিন্তু তারপরেও রাস্তাঘাটে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারছেন না মানুষ। কারণ বড় রাস্তা থেকে অলিগলি, সর্বত্র উপচে পড়ছে জঞ্জাল। খোলা ভ্যাটের দুর্গন্ধে সুস্থ মানুষেরও অসুস্থ হওয়ার জোগাড়।

তবে সাফাই কর্মীরা যে আবর্জনা পরিষ্কার করেন না এমনটা নয়, বরং রোজই নতুন নতুন ভ্যাট গজিয়ে ওঠায় বিব্রত তাঁরাও। শহরের বাসিন্দাদেরও অভিযোগ, আজ যে রাস্তায় ভ্যাট নেই, কালই সেখানে জঞ্জাল উপচে পড়া ট্রলি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। হাতে টানা গাড়িতে করে উঁচু ট্রলিতে জঞ্জাল ফেলতে গিয়ে তা রাস্তায় ছড়িয়ে পূতিগন্ধময় পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ফলে দুর্গন্ধ ও দূষণে টেকা দায় হয়ে পড়ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই খোলা ভ্যাটের পাশে বসছে বাজার। কোথাও কোথাও পুকুর পাড় বা পুরসভার পানীয় জলের কলের পাশেও ভ্যাট গজিয়ে উঠছে।

শহরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, হাসপাতাল চত্বরেও দেখা মিলছে আবর্জনার ট্রলির। যেমন, খোসবাগান পাড়ায় আর বি ঘোষ রোড ও হাসপাতাল রোডের মোড়ে বসেছে বিশালাকায় এক ট্রলি। নিত্য দিন হাসপাতাল, নার্সিংহোমে আসা মানুষজনের অভিযোগ, ওই সংকীর্ণ রাস্তায় এত বড় ট্রলি বসানোয় যানজট আরও বেড়ে গিয়েছে। একই দশাকোর্ট চত্বরের মুখে কাছারি রোড, বাদামতলা মোড়, ভাতছালা রোড, তেঁতুলতলা বাজার, বিবি ঘোষ রোডেরও। রাস্তার একপাশ নোংরার ট্রলিতে ঘেরা থাকায় যানজট , আবার জঞ্জাল গড়িয়ে পড়ায় হাঁটাচলা নিত্য সমস্যা সেখানে।

বীরহাটা আবাসনের একটি পুকুরের পাড়েও বসেছে জঞ্জালের গাড়ি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগে মানুষ স্বচ্ছন্দে সকাল-বিকেল বেড়াতেন, সেখানে দায়ে না পড়লে ঘরের বাইরেই বেরোচ্ছেন না মানুষ। তাঁদের দাবি, বাড়িতে আত্মীয়েরা এলেই মুখে একটাই কথা, এত নোংরা এখানে! ওই জায়গায় পুরসভার একটি পানীয় জলের কলও রয়েছে। আবাসনের বেশিরভাগ বাসিন্দারা সেখানে জল নিতে আসেন। ভ্যাটের জন্য মুশকিলে পড়েছেন তাঁরাও।

৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সনৎকুমার বক্সির কাছে অবশ্য এর উত্তর মেলেনি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বারবার ট্রলি সরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ শুনেও পুরপ্রধান কোনও ব্যবস্থা নেননি। স্থানীয় একটি সাহিত্য পত্রিকার সদস্যদেরও অভিযোগ, পুরসভা ও রেলকে বারবার চিঠি লিখে হয়রান হলেও জঞ্জাল সরেনি। ওই পত্রিকার সম্পাদক স্বপ্নকমল সরকারের আফশোস, “ওখানে পত্রিকার লেখক, কবিরা নিয়মিত আড্ডা মারতেন। আড্ডায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কবি উৎপলকুমার বসুরাও এসেছেন। কিন্তু ভ্যাট হওয়ায় সবই ছাড়তে হয়েছে।”

খোলা ভ্যাটের পাশেই বাজার বসেছে কাছারি রোডে। ছবি: উদিত সিংহ।

অথচ বর্ধমান কালনা রোডে এগ্রিকালচার ফার্মের পাশে দীর্ঘদিন ধরে পুরসভার ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড রয়েছে। জঞ্জাল ফেলতে ফেলতে পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে গিয়েছে ওই মাঠ। এমনকী নোংরা উপচে রাস্তাতেও চলে আসে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ওই পঞ্চায়েত এলাকায় পুরসভার জঞ্জালের দুর্গন্ধ দীর্ঘদিন সহ্য করছেন তাঁরা। একাধিকবার ক্ষোভ-বিক্ষোভও হয়েছে। পুরসভার জঞ্জালবাহী ট্রাক ঢুকতে বাধাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। তাঁদের দাবি, বাম আমলে ওখানে একটি জৈব সারের কারখানা তৈরির কথা হয়েছিল। তৎকালীন পুরবোর্ড দাবি করেছিল, বর্জ্য থেকে জৈব সার তৈরির প্রকল্পের জন্য টেন্ডার ডেকেও লোকের দেখা মিলছে না। আর এই সরকার সে পথে না এগিয়ে ওই ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ড বিক্রির পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে পুরসভার সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল সেলিম খান বলেন, “প্রথম দিকে আমরাও ওই ট্রেঞ্চিং গ্রাউন্ডে বর্জ্য পদার্থ থেকে সার তৈরির কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না। বহু পুরনো জঞ্জাল জমতে জমতে পাথরের মতো হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত সেই কারণেই কেউ দায়িত্ব নিচ্ছেন না।” তাঁর দাবি, “প্রায় ২০ বিঘে এলাকা জুড়ে ছড়ানো জঞ্জাল সরাতে কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। তাই ওই ২০ বিঘে জায়গা আমরা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” বিকল্প হিসেবে তালিতের কাছে বর্ধমান কালনা রোডের গঞ্জ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে পুর এলাকায় জমা জঞ্জালের পরিমান ৭০ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে হয়েছে ১২০ মেট্রিক টন। এই বিপুল জঞ্জাল ফেলতে সাফাই কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে বলেও তাদের দাবি। বর্তমানে স্থায়ী ও অস্থায়ী ৬৮৫ জন কর্মী রয়েছে। এর বাইরে আর্বান ওয়েজ স্কিমে প্রতি ওয়ার্ডে দৈনিক ১০০ টাকায় কিছু কর্মী নিয়োগ করা হয়। বেড়ে চলা জঞ্জাল সামলাতে একটি ৫০ জনের বিশেষ দল তৈরি করা হয়েছে বলেও পুরসভার দাবি।

কিন্তু কবে জঞ্জাল সরবে তার কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিতে পারেনি পুরসভা। সেলিম খানের দাবি, গত তিন বছরে কেন্দ্রীয় ফিনান্স কমিশনের কাছে ২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে বর্ধমান পুরসভার জঞ্জাল সাফাই বিভাগের। টাকা না পাওয়ায় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে পারছেন না তাঁরা।

অগত্যা দুর্গন্ধে বসবাসই নিয়তি এ শহরের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE