Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

৪৬ বছর চাকরি, বেতন তবু ৩৫ টাকাই

দুপুরে স্কুলের চত্বরে গাছের পরিচর্যা। আর রাত হলেই বল্লম আর টর্চ হাতে স্কুল-পাহারা। এটাই প্রতি দিনের রুটিন মেমারির বাগিলা নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের শ্রীদাম সাঁতরার। কিন্তু এই কাজের জন্য সকলের প্রিয় ‘ছিদাম দাদু’র বেতন গত ৪৬ বছর ধরে মাত্র ৩৫ টাকা।

শ্রীদাম: পড়ুয়াদের মাঝে। নিজস্ব চিত্র

শ্রীদাম: পড়ুয়াদের মাঝে। নিজস্ব চিত্র

সৌমেন দত্ত
মেমারি শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৭ ০৩:১৪
Share: Save:

দুপুরে স্কুলের চত্বরে গাছের পরিচর্যা। আর রাত হলেই বল্লম আর টর্চ হাতে স্কুল-পাহারা। এটাই প্রতি দিনের রুটিন মেমারির বাগিলা নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের শ্রীদাম সাঁতরার। কিন্তু এই কাজের জন্য সকলের প্রিয় ‘ছিদাম দাদু’র বেতন গত ৪৬ বছর ধরে মাত্র ৩৫ টাকা।

বাগিলা গ্রামেরই বাসিন্দা, ৬৪ বছরের শ্রীদামবাবু ১৯৭১-র ৫ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে ‘নৈশপ্রহরী-মালি’র পদে যোগ দেন। ১৯৮১-র ৯ এপ্রিল স্কুল বোর্ড শ্রীদামবাবুর নিয়োগের অনুমোদন দেয়। কিন্তু বেতন আটকে থাকে সেই ৩৫ টাকাতেই। অবসরের বয়সের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। শিক্ষা দফতর থেকে অবসরের কোনও নির্দেশও আসেনি।

স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গেই শ্রীদামবাবুর বেতন হতো। বছর তিনেক আগে পর্যন্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের হাত থেকেই তিনি বেতন নিতেন। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রামকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মাস চারেক আগে স্কুল পরিদর্শকের নির্দেশে শ্রীদামবাবুর জন্য আলাদা অ্যাকাউন্ট করা হয়। বেতনের ৩৫ টাকা এখন সেখানে জমা পড়েনি।

এত দিনেও বেতন বাড়েনি কেন? সংসদ সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমানের কাটোয়া, কালনা, মন্তেশ্বর, মঙ্গলকোট-সহ কয়েকটি জায়গায় শ্রীদামবাবুর মতো কয়েকজন রয়েছেন। শিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সত্তরের দশকে ‘জেলা স্কুল বোর্ড’-এর গড়া স্কুলে প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকারাই নৈশপ্রহরী-মালি পদে নিয়োগ করতেন। পরে সে পদের অনুমোদন দিত বোর্ড। আশির দশকে স্কুল বোর্ডের অবলুপ্তির সঙ্গে ওই পদে নিয়োগও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের আমলেও থেকে যান ‘নৈশপ্রহরী-মালি’রা।

জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের (ডিপিএসসি) সভাপতি অচিন্ত্য চক্রবর্তী বলেন, “বর্ধমান জেলায় এ রকম কয়েকজন রয়েছেন বলে জানি। ওঁরা বেতন বাড়ানোর জন্য আমার কাছে আবেদন করলে, দেখতে পারি।” জেলা প্রাথমিক স্কুল পরিদর্শক অলোক চট্টোপাধ্যায় আবার বলেন, “শিক্ষা সংসদের আমলে কেন ওঁদের বেতন বাড়েনি, তা খোঁজ নিতে হবে।’’

শ্রীদামবাবুর পাসবই, চেকবই, এটিএম কার্ড গচ্ছিত রয়েছে স্কুলেই। স্কুলের শিক্ষকেরাই পাস বই ‘আপ-টু-ডেট’ করে দেন। শ্রীদামবাবু স্কুলের চত্বরে আম গাছ, ফুলগাছ আর সামান্য জায়গায় লঙ্কা চাষ নিয়ে ব্যস্ত। স্কুল-পাহারা দেওয়ার কাজও বন্ধ হয়নি। বেতন না তুলে কাজ করেন কেন? শ্রীদামবাবুর জবাব, ‘‘স্কুল আর বাচ্চাদের মায়ার বাঁধন কাটাতে পারি না।’’ স্বামীর এমন স্কুল-প্রেম নিয়ে ঘরে ঝগড়া করতেন তাঁর স্ত্রী মালতিদেবী। তাঁর কথায়, ‘‘খুব রাগ হতো। কিন্তু স্কুল আর বাচ্চারা ওঁর জীবন। সামান্য জমি থেকে যা আয় হয়, তাতে আমাদের চলে যায়।’’

বেতন না বাড়লেও ভালবাসা-শ্রদ্ধার অভাব নেই শ্রীদামবাবুর ঝুলিতে। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র স্নেহাশিস সাঁতরা, প্রলয় পালের কথায়, ‘‘শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—স্কুল-পাহারায় ছিদামদাদুই ভরসা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sridam Santra salary rupees 35 Memari
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE