তাঁতশিল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছেন বাড়ির মহিলারা। কালনার উত্তর গোয়ারায়। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল
কৃষি বাদ দিলে একটা সময়ে বর্ধমান-সহ রাঢ় অঞ্চলের বিরাট অংশের সাধারণ মানুষ যে শিল্পকে নিজেদের রুটিরুজির প্রয়োজনে প্রধান জীবিকা হিসাবে গণ্য করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে তাঁতশিল্প। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারণের চাহিদাকে মেটাতে সক্ষম হওয়ার পরে পূর্ব বর্ধমানের সমুদ্রগড়, পূর্বস্থলী, ধাত্রীগ্রাম, কালনা, কাটোয়া প্রভৃতি এলাকায় তাঁতজাত বস্ত্র সেই কোন সুদূর অতীত থেকে শুরু করে আজও স্রষ্টার সৃজনমূলক মানসিকতা ও সৌন্দর্যবোধে বিশ্বের দরবারে হাজির হয়ে চলেছে।
সাধারণ ভাবে লোকশিল্পের মধ্যে থাকে বংশগত এবং গোষ্ঠীগত ধারাবাহিকতা ও কুশলতা। যাকে ঐতিহ্যাশ্রয়ী বলে ব্যাখ্যা করা হয়। বিশেষ়জ্ঞেরা বলেন, লোকশিল্প হল ‘পরম্পরাগত প্রকৃতি, অপণ্ডিত সুলভ, অপ্রশিক্ষিত কলা’।
পূর্ব বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রশিক্ষণহীন পরম্পরাগত নানা লোকশিল্পের মধ্যে তাঁতশিল্প অগ্রগণ্য। কেননা, এই শিল্পে একদা জীবিকা নির্বাহের নিশ্চয়তা অনেকটাই ছিল। মাঝে ভাটা পড়লেও এই শিল্পের সঙ্গে এখনও বহু মানুষ যুক্ত আছেন। নারী-পুরুষ প্রায় সমভাবে। যেহেতু তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের কাজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গৃহস্থ বাড়িতেই সম্পন্ন হতো বা এখনও হয়, তাই মহিলাদের যোগদান অত্যন্ত স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
নির্দিষ্ট পরিমাপের সুতো থেকে একটি পরিপূর্ণ তাঁতবস্ত্র উৎপাদনে পুরুষ ও নারী উভয়েরই ভূমিকা প্রায় সমান হলেও এই গোটা প্রক্রিয়াতে এমন কিছু কাজ আছে, যা শুধু নারীরাই করে থাকেন। এক সময়ে মহিলারা সরাসরি তাঁতবস্ত্র বুননের কাজ করলেও একটি সরকারি সমীক্ষায় প্রকাশ, আলোচ্য এলাকাতে বর্তমানে মাত্র ১৮ শতাংশ এই কাজ করেন। বাকি ৮২ শতাংশ মহিলা তাঁতবস্ত্র উৎপাদনের যে কাজগুলিতে যুক্ত থাকেন, তা লক্ষ করার আগে জানা প্রয়োজন একটি তাঁতবস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রাথমিক কাজগুলি কী-কী।
পূর্ব বর্ধমান অথবা সাবেক বর্ধমান জেলার কোথাও সেই অর্থে সুতো উৎপাদনের কারখানা নেই। তাই কলকাতা থেকে কেনা সুতো মহাজন বা বড় ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে তা সাধারণ তাঁতশিল্পীর বাড়িতে আসে। ১২ ‘ফেট’ (১ ফেট= ২০০ গ্রাম) সুতো দিয়ে একটি কাপড়ের ‘বান’ বা ‘আড়’ তৈরি হয়। শিল্পীর বাড়িতে সুতো আসার পরে তা বুননের উপযোগী ও মজবুত করার জন্য খইয়ের মাড় দেন পুরুষেরা। এর পরে এই মাড় দেওয়া সুতোর বাণ্ডিল থেকে এক-একটি নির্দিষ্ট মাপের লাটাইয়ে সুতো গোটানোর কাজ চলে। এই কাজের পুরোটাই করেন মহিলারা।
গোল করে সুতো গোটানোর পরে হাতে সুতো ভেঙে ভেঙে পাটকাঠিতে গোটানোর কাজ চলে। এক-একটি পাটকাটিতে ৬০-১০০ পাক ‘কাউন্ট’ করে সুতো গোটানো হয় (শান্তিপুরে এই পরিমাপ ৬০-৮০ কাউন্ট)। সুতোর পাক গণনার জন্য স্থানীয় ভাবে ‘কাউন্ট’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সুতো গোটানোর এই কাঠিগুলিই সরাসরি তাঁতযন্ত্রের নির্দিষ্ট খাপে আশ্রয় নিয়ে সুতো সরবরাহ করে। একটি পাটকাঠির সুতো ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী কাঠি যন্ত্রের ভিতরে ‘সেটিং’ (স্থানীয় ভাষায়) করা হয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুতো গোটানোর জন্য অন্যতম পুরনো পদ্ধতিতে ছোট ছোট কাঠের চরকাও ব্যবহার করা হয়। সে চরকাগুলিও মহিলারাই হাতে ঘোরান। খেয়াল রাখতে হবে, তাঁতের শাড়ির পাড় কিন্তু একটি সম্পূর্ণ শাড়ির সঙ্গে একই সঙ্গে তৈরি করা হয় না। যেহেতু বিভিন্ন শাড়ির পাড় ভিন্ন ধরনের নকশাযুক্ত হয়, তাই চাহিদা অনুযায়ী পাড়গুলিকে আলাদা ভাবে তৈরি করে শাড়ির সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এই পাড় তৈরির কাজ চলে আবার বিশেষ ধরনের লম্বাটে-গোল আকৃতির একটি কাঠের বা পাতলা লোহার দণ্ড ব্যবহার করে, যাতে পাড়টি গোটানো অবস্থায় রাখা যায়। স্থানীয় ভাবে এই দণ্ডটিকে ‘ড্রাম’ বা ‘জালা’ বলা হয়। এক-একটি বাড়িকে কেন্দ্র করে এই জালা তৈরির প্রক্রিয়া চলে। এই সব বাড়িকে তাঁতশিল্পীরা ‘ড্রামবাড়ি’ বলে উল্লেখ করেন।
‘ড্রামবাড়ি’তে পাড় তৈরি ও পাড়ের উপরে নানা ধরনের সুতোর গুটি তৈরির কাজে প্রধানত মহিলারাই যুক্ত থাকেন। সুতো ও পাড় কাজের উপযোগী হওয়ার পরে পুরুষ কারিগর একটি সম্পূর্ণ তাঁতবস্ত্র তৈরি করেন। আবার, অনেক ক্ষেত্রে এমনটাও দেখা যায়, বাজার থেকে সাদা সুতো কেনার পরে তা অর্ডার অনুযায়ী শিল্পী রং করে নেন। সুতোয় রঙের প্রলেপ দেওয়া ও তা শুকানোর কাজটিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলারাই করে থাকেন। প্রধানত পুরুষ কারিগরেরাই নকশা চিত্রিত করলেও বাড়ির মহিলাদের ভাবনাচিন্তাও থাকে সেই নকশার পিছনে।
রাজ্য সরকারের হস্ত তাঁত উন্নয়ন দফতরের তথ্য অনুযায়ী, কালনা-পূর্বস্থলী-সমুদ্রগড়-ধাত্রীগ্রাম এলাকায় প্রায় ৩৯ হাজার তাঁতশিল্পী আছেন, যার প্রায় অর্ধেক নারী। আরও একটি তথ্য হল, এই তাঁতশিল্পীদের মাত্র ২০ শতাংশ স্বাধীন ভাবে কর্মরত। বাকি ৮০ শতাংশকে কাঁচামাল সরবরাহ করে ও তাদের উৎপন্ন বস্ত্র কেনে স্থানীয় তাঁত সমবায় সমিতিগুলি। এই সমিতিগুলির পরিচালন সমিতিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় সম্পন্ন মহাজন বা ব্যবসায়ীরা থাকার কারণে প্রকৃত তাঁতশিল্পী তাঁর গুণের কদর পান না।
ইতিহাস ব্যক্ত হয় ঐতিহাসিক চিহ্নে-দলিলে, শিল্প, ভাস্কর্যে। বস্ত্রের বয়ানে ফুটে ওঠে এক-একটি বিশেষ কালের চালচিত্র, যা বদলায় সুতোর বিন্যাসে। শুধু বদলায় না প্রকৃত তাঁতশিল্পীর জীবনযাত্রার মান। শাড়ির নকশা কদর পায় সমঝদারের চোখে, কিন্তু কদর পায় না সেই নারীর মূল্যায়ন, যিনি ওই নকশা উদ্ভাবন ও উৎপাদনে সমান অবদান রাখেন।
লেখক স্কুল শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy