কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদের দাবি, তাদের আমলে কৃষকের আয় বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু আয় যদি বাড়ে, তা হলে সারা দেশের সঙ্গে এ বঙ্গেও চাষির অপমৃত্যু হচ্ছে কেন, সে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। রবিবার গভীর রাতে কালনার বাঘনাপাড়ার কয়া গ্রামের এক আলুচাষির অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে বিরোধীদের এই প্রশ্নে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক তরজা।
মঙ্গলবার দুপুরে বাঘনাপাড়ায় মৃত চাষি মাধব মাঝির বাড়ি যান বর্ধমান পূর্ব লোকসভার বিজেপি প্রার্থী পরেশচন্দ্র দাস। তিনি দাবি করেন, এক দিকে সাম্প্রতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হওয়ায়, অন্য দিকে খোলা বাজারে আলুর দাম না পাওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যে আত্মহত্যা ছাড়া ওই চাষির সামনে কোনও পথ খোলা ছিল না। যদিও জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি তৃণমূলের দেবু টুডুর দাবি, স্থানীয় ভাবে জানা গিয়েছে, ব্যক্তিগত কারণে ওই চাষি মারা গিয়েছেন। বিজেপি বিষয়টা নিয়ে রাজনীতি করছে।’’
বিজেপির অভিযোগ, কৃষকদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে রাজ্য গড়িমসি করছে। তাই প্রান্তিক চাষিরা কেন্দ্রের সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পরেশবাবু বলেন, ‘‘আমরা সে কথা প্রচারে তুলে ধরছি।’’ ওই পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরব হন তিনি।
সিপিএম আবার বিজেপির দাবিকে কটাক্ষ করেছে। তাদের দাবি, বর্ধমানে গত তিন বছরে ৩৮ জন কৃষক স্রেফ চাষের জন্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। চাষে ক্ষতি সহ্য করতে না পেরে বা মহাজনের ঋণের চাপ সামলাতে না পেরে ২০১৭ সালে পূর্ব বর্ধমানে ২১ জন, ২০১৮ সালে ১২ জন চাষি আত্মঘাতী হন। এ বছরের প্রথম তিন মাসেই পাঁচ জন চাষির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে জেলায়। বাঘনাপাড়ারই চাঁদপুর গ্রামের কালীপদ দাস গত ১২ ফেব্রুয়ারি আলুর দর না পেয়ে আত্মঘাতী হন বলে পরিবারে দাবি করে। মাধববাবুর মৃত্যুর পরে, তাঁর স্ত্রী বীণারানি মাঝি দাবি করেন, চাষের জন্য বেসরকারি ব্যাঙ্ক, ঋণদায়ী সংস্থা থেকে টাকা নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। গয়নাও বন্ধক দেন। তোলার ঠিক আগে দিন তিনেকের বৃষ্টিতে জমা জলে পচে যায় বেশির ভাগ আলু। সামান্য কয়েক বস্তা আলু মিলেছিল। তা-ও জলের দরে বিক্রি করতে হয়। তাতে মানসিক বিপর্যস্ত মাধববাবু আত্মঘাতী হন। ব্লক প্রশাসন অবশ্য সে কথা মানেনি।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিকের দাবি, “বিজেপির আমলে গোটা দেশে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ৪০ শতাংশ বেড়েছে। আমাদের রাজ্যেও গত সাত বছরে অন্তত ২০০ জন কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন। এই দুই সরকার কৃষকদের জীবনে কী ভাবে অন্ধকার নিয়ে এসেছে, সেটাই প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে।’’ বামপন্থী কৃষক সংগঠন ‘কৃষকসভা’র জেলা সভাপতি উদয় সরকারের বক্তব্য, “কেউ বলছে তিন গুণ, কেউ বলছে চাষির আয় দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। তা হলে পরপর অপমৃত্যু হচ্ছে কেন?’’ সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক অমল হালদারের মন্তব্য, “বিষ মদ আর চাষি-মৃত্যুকে একই চোখে দেখছে তৃণমূল সরকার। তার প্রতিবাদ করে আমরা প্রতি কৃষকমৃত্যুর জন্যে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছি।’’
কংগ্রেসের পূর্ব বর্ধমানের প্রার্থী সিদ্ধার্থ মজুমদারও এ দিন বলেন, “এ রাজ্যে কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাই প্রমাণ করে দিচ্ছে, কৃষি-ক্ষেত্রে সঙ্কট শুরু হয়েছে। সেখান থেকে কৃষকদের বেরোতে হবে। তার দিশা আমরা দেখাচ্ছি।’’ এসইউসি-র তরফে এ দিন অপমৃত মাধব মাঝির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয় মহকুমাশাসককে (কালনা)। ঋণগ্রস্ত চাষিদের ঋণ মকুবেরও দাবি করা হয়।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথ অবশ্য জানাচ্ছেন, বিরোধীদের ‘মিথ্যা’ অভিযোগের জবাব দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষকদের জন্যে কী-কী উন্নতি করেছেন, তা প্রচারে তুলে ধরা হচ্ছে। তাঁর পাল্টা দাবি, ‘‘চাষে বিপর্যয় হলে কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর কথা আগে কেউ ভেবেছিলেন? ফসলের বিমা করানোর টাকা রাজ্য সরকার দিচ্ছে। তার সুফল চাষিরা পেয়েছেন। কৃষি-যন্ত্রে ভর্তুকি থেকে শুরু করে খেতমজুরদের উন্নতির কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে কেউ ভাবেননি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy