Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবী, শুধুই কি অঙ্গীকার?

পৃথিবীতে প্লাস্টিকের বাৎসরিক উৎপাদন কয়েক লক্ষ টন এবং ভারতে মাথা পিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের হার প্রতি বছরে কয়েক কিলোগ্রামে দাঁড়িয়েছে। তাই এখনও প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবী গড়া তো দূরের কথা, দিশাটুকুও জাগিয়ে তুলতে পারিনি। লিখছেন লক্ষ্মণদাস ঠাকুরাকার্বনঘটিত যৌগ ইথালিনের অনেকগুলি অণুকে পলিমারাইজ় করে তৈরি করা হয় পলিমার।

সমুদ্রেও প্লাস্টিক। ছবি: আইস্টক

সমুদ্রেও প্লাস্টিক। ছবি: আইস্টক

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৯ ০১:২৫
Share: Save:

বিশ্বের প্রত্যেকটি বিষয় পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ। সেই বন্ধনকে উপেক্ষা করে এমন সাধ্য নেই কারও। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেন, এই বিশ্বে কোথাও সামান্যতম সমস্যা দেখা দিলেই তার প্রভাব পড়ে সমগ্র পরিবেশে। অন্য বছরের মতো এ বারেও পরিবেশ দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা অঙ্গীকার করেছি, পৃথিবীকে আমরা বাসযোগ্য করে যাব। কিন্তু সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, আশ্বাসই সার, কেউ কথা রাখেনি। পরিবেশ দূষণ কমাতে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছি, কিন্তু তার কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি ছিল, প্লাস্টিকমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা। কিন্তু ক্রমেই প্লাস্টিক দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

কার্বনঘটিত যৌগ ইথালিনের অনেকগুলি অণুকে পলিমারাইজ় করে তৈরি করা হয় পলিমার। এই যৌগে দু’টি করে হাইড্রোজেন অণুর সঙ্গে একটি করে কার্বন পরমাণু সংযুক্ত থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কার্বনঘটিত যৌগ হওয়া সত্ত্বেও কেন বারবার প্লাস্টিক বা পলিথিনকে বর্জন করার প্রস্তাব উঠছে। কেনই বা তাকে প্রাণীদের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ বলা হচ্ছে? উত্তরটা, আমাদের সকলেরই জানা। প্লাস্টিক একটি ‘নন বায়োডিগ্রেডেবল’ দ্রব্য। অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপায়ে তাকে ধ্বংস করা অসম্ভব। তার কারণেই যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হিসেবে এই প্রকৃতিতে মিশছে তা মাটি বা আলোর মতো প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। বিপদ ঘটাচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের।

প্লাস্টিক ব্যবহার রোধের জন্য প্রশাসনিক স্তরে সতর্কতা ও বিজ্ঞপ্তি জারির কথা বলে থাকেন অনেকেই। প্লাস্টিক দূষণে লাগাম টানতে প্রশাসনিক পর্যায় থেকেও কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বেশ কিছু জায়গায় চল্লিশ মাইক্রনের নীচে প্লাস্টিক ব্যবহারের উপরে বিধি নিষেধ আরোপ করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও কোথাও লুকিয়ে চুরিয়ে কোথাও প্রকাশ্যেই এই বিধিনিষেধ ভাঙা হচ্ছে। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া লোকসভা নির্চবাচনেও আমরা দেখেছি প্লাস্টিকের ব্যানার ফেস্টুনের অবাধ ব্যবহার চলেছে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, পরিবেশকে রক্ষার তাগিদে নির্বাচনী প্রচারকে ‘প্লাস্টিকমুক্ত’ করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন পরিবেশপ্রেমীদের একাংশ। কিন্তু বাস্তব বলছে তাতেও নির্বাচনী প্রচারকে পুরোপুরি ‘পরিবেশবান্ধব’ করে তোলা সম্ভব হয়নি। নির্বাচন মিটে যাওয়ার পরেও দেখা গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায় ইতস্তত পড়ে রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যানার হোর্ডিং। প্রশাসনও যে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো নিয়ে সক্রিয় তাও বলা যায় না। না হলে ভাবতে অবাক লাগে আমাদের মতো একটি বিপুল জনবসতিপূর্ণ দেশে যেখানে প্রতিদিন বহু টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে সেখানে আজ পর্যন্ত কোনও প্লাস্টিক নষ্ট করার পরিবেশবান্ধব বন্দোবস্ত গড়ে উঠল না।

এই ধ্বংস ব্যবস্থা না থাকার কুফল গুণতে হচ্ছে পরিবেশের প্রত্যেকটি জীবকে। মাটির উপরের স্তর আজ প্লাস্টিকে ঢেকে যাচ্ছে। মাটির উপরে পড়ে থাকা প্লাস্টিক হাজার বছরেও মাটির সঙ্গে মিশে যাবে না। কিন্তু তার মধ্যে থাকা কয়েকটি যৌগ কোনও ভাবে মুক্ত হতে পারলে মাটির ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে। আমাদের অনেকেই অজ্ঞতাবশত প্লাস্টিক পুড়িয়ে বিপদ আরও বাড়িয়ে ফেলি। আমরা অনেকেই জানি না যে প্লাস্টিক পোড়ালে তা থেকে ডাই অক্সিন, ফিউরান ও স্টাইরিনের মতো বিষাক্ত ভারী গ্যাস তৈরি হয়। সেগুলি খাদ্য ও পানীয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের দেহে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কর্মক্ষমতা নষ্ট করে।

অনেক সময় আমরা প্লাস্টিক না পুড়িয়ে জলাশয়, নদী, সমুদ্রে ফেলে দিই। তার ফলাফল হয় আরও ভয়ানক। মানুষের করার পাপের ফল ভুগতে হচ্ছে সমুদ্রবাসীদেরও। সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র আমাদের এই ধরনের কাজের ফলে ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নানা সামুদ্রিক প্রাণী ভুল করে প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। এতে তাতে তাদের মৃত্যুও ঘটছে। কিছুদিন আগেও বিশ্বজুড়ে ঝড় তুলেছিল মৃত তিমির পেট থেকে টন টন প্লাস্টিক উদ্ধারের চিত্রটি। তারই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে আটকে দমবন্ধ হয়ে মারা যাওয়া ক্ষুদ্র সামুদ্রিক জীবের মৃতদেহও। কিন্তু তার পরেও আমাদের চেতনা ফেরেনি। এর মধ্যেই এক দল মানুষ আমাদের সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের মতো করে।

সাম্প্রতিক কালে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ৮৩০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়েছে এবং তার মধ্যে ২৫০ টন এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে। ৪৯০ কোটি টন আবর্জনায় পরিণত হয়েছে এবং বাকি অংশের কিছুটা পুনর্নবীকরণ করে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হয়েছে। কিছুটা অংশ ইনসিনারেটরে পোড়ানো হয়েছে। এই ৪৯০ কোটি টন প্লাস্টিকের অন্তত পাঁচ থেকে দশ শতাংশ সমুদ্রে মিশেছে। বাকি ৯০-৯৫ শতাংশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পোড়ানো হয়েছে। পোড়ানোর ফলে যে বিষাক্ত গ্যাসগুলি তৈরি হচ্ছে তাতে নানা শারীরিক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ক্যানসার আক্রান্ত ও হৃদরোগীর সংখ্যা।

এই রকম এক ভয়ানক পরিবেশ দাঁড়িয়েও পৃথিবীতে প্লাস্টিকের বাৎসরিক উৎপাদন কয়েক লক্ষ টন এবং ভারতে মাথা পিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের হার প্রতি বছরে কয়েক কিলোগ্রামে দাঁড়িয়েছে। তাই এখনও আমরা প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবী গড়া তো দূরের কথা, তার সামান্য দিশাটুকুও জাগিয়ে তুলতে পারিনি। ফলে সামনের সময় আমাদের জন্য বড়ই বিপজ্জনক। অবিলম্বে প্লাস্টিক বর্জন করতে না পারলে হয়তো আরও ভয়ানক পৃথিবী আমাদের জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে।

লেখক বিসিডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Environment Plastic Pollution
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE