Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
দুর্ঘটনার বলি ডাঙাপাড়ার ৮

চুড়ি-খেলনা আর এল না, শোকে গ্রাম

শুক্রবার দুপুরে মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়়ে নিয়ে পুঁতির হার কিনে আনার আবদার জানিয়েছিল বছর দশেকের রওসনা খাতুন। ফোনে মেয়েকে আশ্বস্ত করেছিলেন সৈয়দ শেখ।

শোকস্তব্ধ মারফতের পরিবার।

শোকস্তব্ধ মারফতের পরিবার।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য ও সুব্রত সীট
পূর্বস্থলী ও দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৭ ০১:০৭
Share: Save:

শুক্রবার দুপুরে মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়়ে নিয়ে পুঁতির হার কিনে আনার আবদার জানিয়েছিল বছর দশেকের রওসনা খাতুন। ফোনে মেয়েকে আশ্বস্ত করেছিলেন সৈয়দ শেখ। কিন্তু বাবা আর বাড়ি ফিরবে না, রবিবার সকালে সে কথা জানার পরে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিল পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রওসনা।

বছরখানেক আগেই বিয়ে হয়েছে রেহানা বিবির। রবিবার সকাল থেকে বাকরুদ্ধ বছর কুড়ির এই বধূ। স্বামী সুকুর আলি শেখ মেলা থেকে চুড়ি কিনে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বিড়বিড় করে রেহানা শুধু বলছেন, ‘‘কথা রাখার আগেই চলে গেল।’’

ছেলের জন্য খেলনা আনবেন, বলে গিয়েছিলেন মারফত শেখ। সে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী আরিফা বিবি। চার বছরের সামিজুল অবশ্য কিছু বুঝছে না। মায়ের কোলে বসে আইসক্রিম খেয়ে চলে সে।

রবিবার সকাল থেকেই শোকের আবহ পূর্বস্থলী ১ ব্লকের নসরতপুর পঞ্চায়েতের ডাঙাপাড়ায়। বৃহস্পতিবার গ্রামের যুবক আব্দুল আলিম শেখের গাড়িতে চড়ে বীরভূমের পাথরচাপুড়ি মেলায় গিয়েছিলেন এলাকার আট যুবক। রবিবার ভোরে ফেরার সময়ে কাঁকসার ধোবারুর কাছে গাড়িটিতে ধাক্কা মারে আলুর ট্রাক। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ছ’জনের। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে এক জন ও পরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আরও এক জনের মৃত্যু হয়। কিতাব আলি শেখ নামে এক জন বর্ধমান মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন।

ডাঙাপাড়া এলাকায় হাজার দশেক মানুষের বাস। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই তাঁত বোনেন। এলাকায় গেলেই শোনা যায় তাঁত বোনার খটখট। রবিবার অবশ্য নিঃস্তব্ধ গোটা এলাকা। সকাল থেকে তালা খোলেনি কোনও দোকানে। বহু বাড়িতেই রান্না চড়েনি। গ্রামবাসীরা জানান, প্রতি বছরই ওই মেলায় যান গ্রামের অন্তত হাজার দেড়েক মানুষ। মেলা ঘুরে মোরব্বা, মিষ্টি, ছেলেমেয়েদের জন্য খেলনা-সহ নানা জিনিস নিয়ে ফেরেন। সে জন্য কয়েক মাস ধরে টাকাও জমান।

এ দিন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছন গ্রামের অনেকে। সুকুর আলির দাদা সাহাবুদ্দিন শেখ বলেন, ‘‘ভাইকে যেতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু শুনল না!’’ আব্দুলের জামাইবাবু মাহিবুল শেখের খেদ, ‘‘গাড়ি নিয়ে কত জায়গায় যেত। এমন কী করে হয়ে গেল বুঝতে পারছি না!’’ বাড়ির উঠোনে মাথা ঠুকে আব্দুলের মা আজিদা বেওয়া বলেন, ‘‘অনেক কষ্টে গাড়িটা কিনেছিল। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে ছিল ও।’’ গ্রামের যুবক হুমায়ুন শেখ বলছিলেন, ‘‘দুর্ঘটনায় গরিব বাড়ির বহু ছেলেমেয়ে অভিভাবকহীন হল। এত বড় ধাক্কা গ্রামে আর কখনও আসেনি।’’

পূর্বস্থলী দক্ষিণের বিধায়ক তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ, জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক এ দিন গ্রামে যান। স্বপনবাবু জানান, মৃতদের পরিবারকে নানা ভাবে সাহায্যের আশ্বাস দেন।

পানাগড়-দুবরাজপুর রাজ্য সড়কে দুর্ঘটনাস্থল দেখে পুলিশ কর্তাদের অনুমান, কোনও গাড়ির চালক হয়তো ভোরে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তবে যে ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে তাতে ট্রাকটির দায়ই বেশি বলে পুলিশের ধারণা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আহত কিতাব আলি শেখ অবশ্য ইশারায় দাবি করেন, তাঁদের চালক ঘুমিয়ে পড়েননি। পুলিশ জানায়, ওই রাস্তায় ডিভাইডার তৈরির ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Road Accident Durgapur Purbasthali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE