Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

পুজোর আগেই ফিরবে ছেলে, আশায় বসে মা

ঘরের কোণে ঝুল জমা হলে বিরক্ত হত সে। সব সাফসুতরো রাখাই ছিল পছন্দের। তাই বছর পেরিয়েও রোজ পরিপাটি করে রাখা হয় তার বিছানা। পরিষ্কার করা হয় কম্পিউটার।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সৌমেন দত্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৪৭
Share: Save:

ঘরের কোণে ঝুল জমা হলে বিরক্ত হত সে। সব সাফসুতরো রাখাই ছিল পছন্দের। তাই বছর পেরিয়েও রোজ পরিপাটি করে রাখা হয় তার বিছানা। পরিষ্কার করা হয় কম্পিউটার।

এক দিন ঠিক ফিরে আসবে ছেলে, বিশ্বাস করেন মৃদুলাদেবী। তাই কষ্ট হলেও প্রতিদিন দু’বেলা ঘরদোর সাফ করে রাখেন তিনি। হেসে বলেন, ‘‘আমার মনের খুব জোর। খারাপ কিছু মনে ঠাঁই দিই না। সময় হলেই মানাই ফিরে আসবে।’’

দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র প্রিয়দীপ কুণ্ডুকে ‘মানাই’ নামেই ডাকেন মা মৃদুলাদেবী। বাড়ির অন্যদের কাছে সে সায়ন। বর্ধমান থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে দে পাড়ায় কুণ্ডুবাড়িতে ম্যারাপ বাঁধার কাজ চলছে। দু’দিন পরেই পুজো। দোতলা বাড়িতে বসে মহিলা বলে চলেন, ‘‘ঠিক পুজোর আগে ফিরে আসবে ও। মণ্ডপ থেকে কিছুটা দূরে ঘাটে কলা-বৌ স্নান করাতে যাবে।’’

গত বছর ২১ সেপ্টেম্বর কলা-বৌ স্নান করাতেই ছেলেকে নিয়ে কাটোয়ায় গিয়েছিলেন স্বামী-স্ত্রী। গত কয়েক বছর ধরে প্রিয়দীপই বাড়ির পুজোর কলা-বৌকে স্নান করাতে নিয়ে যায়। সাধারণত নবদ্বীপে যেত কুণ্ডু পরিবার। কিন্তু গত বছর ছেলেকে নিয়ে তাঁরা স্কুটিতে করে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে কাটোয়ায় ভাগীরথীর দেবরাজ ঘাটে গিয়েছিলেন। মৃদুলাদেবী বলেন, “ছেলের যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। সে দিন প্রজেক্ট জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। কিন্তু কলা-বৌ স্নান করানোর জন্য গঙ্গায় ডুব দেওয়া উচিত জানার পরে ও আমাদের সঙ্গে যেতে চায়।’’

সকাল ১১টা নাগাদ তাঁরা বেরোন। রাস্তায় দু’তিন বার দাঁড়ানোর পরে দুপুর ১টা নাগাদ দেবরাজ ঘাটে পৌঁছন। মৃদুলাদেবীর কথায়, ‘‘মানাই আগে স্নান করতে চাইল। আমরা বারণ করিনি। ওর দিকে নজর রেখেছিলাম। কোনও রকমে দু’টো ডুব দিল। তার পরে আমি প্যাকেট থেকে কাপড় বার করে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখি, মানাই নেই।’’ পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা হরনাথবাবু। লোকারণ্য ঘাটে চার দিক থেকে ‘ডুবে গেল, ডুবে গেল’ চিৎকার। টানা কয়েকদিন প্রিয়দীপের খোঁজে নদীতে তল্লাশি চালানো হয়। খোঁজ মেলেনি। বছর পেরিয়েছে। এসে গিয়েছে আর একটি দুর্গাপুজো। এখনও প্রিয়দীপ ফেরেনি।

মৃদুলাদেবী বলেন, ‘‘সব সময় ছেলের মুখ দেখতে ইচ্ছা করে। একটি খামে ছবি রেখে দিয়েছি। আর আছে স্কুলের পরিচয়পত্রে। ওই ছবিগুলো দেখি। বুকে জড়িয়ে ধরি।’’ তবে কাঁদেন না তিনি। খানিক চুপ করে থেকে বলেন, ‘‘আমার মনে ‘নেগেটিভ’ কিছু নেই। একটা ফাঁড়া রয়েছে। সময় হলে ঠিক চলে আসবে। আমি তো সারাক্ষণই ভাবি, আমার মানাই ট্রেনিংয়ে গিয়েছে।’’ গাছের নীচে মার্বেল রেখে দিয়েছিল প্রিয়ব্রত। ফেলতে বারণ করেছিল। সেগুলি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন মা।

প্রিয়ব্রতর ঠাকুমা সাধনাদেবী অবশ্য কাঁদেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার সঙ্গেই সারা দিন থাকত। আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোত। সব সময় মনে হয়, আমার আশপাশেই ঘুমোচ্ছে।’’ তাঁকে কাঁদতে দেখে মৃদুলাদেবী বলেন, ‘‘কাঁদতে হলে মহাময়ার কাছে যান। তিনিই তো মানাইকে ফেরাবেন।’’

মহামায়া এই পরিবারের দেবী। প্রতিমার গায়ে শোলার সাজ। পুজোর তোড়জোড় চলছে। মৃদুলাদেবী বলে ওঠেন, “ছেলে না থাকলে সব অন্ধকার। এক বছর কোথাও যাইনি। কী ভাবে দিন কাটছে, বলে বোঝাতে পারব না। মা অন্ত প্রাণ আমার ছেলে। আমি জানি, ও ঠিক ফিরে আসবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga pujo Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE