ঝাঁ চকচকে সিটি সেন্টারের থেকে স্টেশন বেশি পছন্দ। শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে শোওয়ার জন্য জায়গা দখল করেন ভবঘুরেরা। শেষ পর্যন্ত একটুখানি জায়গায় কোনওমতে সামান্য কিছু গায়ে চাপা দিয়ে গুটিয়ে শুয়ে থাকেন তাঁরা।
গত এক দশকে দুর্গাপুর শহরের অবয়ব বদলে গিয়েছে অনেকখানি। শপিং মল, হোটেল, মাল্টিপ্লেক্স, দেশি-বিদেশি সংস্থার শো-রুম, তথ্যপ্রযুক্তি পার্ক, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ম্যানেজমেন্ট কলেজ, হাসপাতাল গড়ে উঠেছে একের পর এক। কিন্তু এসবের মাঝে নিরাশ্রয় ভবঘুরেরা বেশ বেমানান। দিনভর তাঁদের দেখা মেলে শহরের নানা জায়গাতেই। কখনও সিটি সেন্টারে, প্রান্তিকা বাসস্ট্যান্ডে বা স্টেশনে। কিন্তু রাতে শীতকালে তাঁদের অনেকে বিপাকে পড়েন। ঠান্ডার প্রকোপে অনেকের মৃত্যুও হয়। এমন মানুষদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য দুর্গাপুর শহরে ভবঘুরেদের জন্য ভবন থাকার কথা। কিন্তু তা না থাকায় বিপাকে পড়েন এই সব আশ্রয়হীন মানুষজন। বিশেষত নদিয়ার কৃষ্ণনগর-সহ অনেক জেলাতেই পুরসভার উদ্যোগে বা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পে ভবঘুরেদের জন্য ভবন হয়েছে। তারপরে ক্ষোভ আরও বেড়েছে শহরে।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের তৎকালীন ‘জহরলাল নেহরু আরবান রিনিউয়াল মিশন’ (জেএনএনইউআরএম) প্রকল্পের আওতায় থাকা এবং ৫ লক্ষের বেশি জনসংখ্যার শহরগুলিতে ভবঘুরেদের জন্য ভবন থাকার নির্দেশ রয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের। সেখানে আশ্রয় নেওয়া ভবঘুরেদের জন্য বিছানা, লেপ, তোষক থেকে শুরু করে পানীয় জল, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকার কথা। সরকারি উদ্যোগে ভবন গড়ে দেওয়ার পরে তা পরিচালনার জন্য সাধারণত তুলে দেওয়া হয় কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাতে। দুর্গাপুর জেএনএনইউআরএমের আওতায় ছিল। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষের কাছাকাছি। কাজেই এই শহরে ভবঘুরেদের জন্য ভবন থাকা উচিত। কিন্তু প্রশাসন তা গড়তে উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ।
সব থেকে বড় সমস্যা অবশ্যই শীতের রাত। সিটি সেন্টার বা বাসস্ট্যান্ডে ভবঘুরেদের রোজ রাতে দেখা যায় না। তবে রেল স্টেশনে গিয়ে দেখা গিয়েছে, রাতে শোবার জন্য পছন্দের জায়গা নিয়ে ভবঘুরেদের মধ্যে রীতিমতো অশান্তি চলছে। ট্রেন থেকে নেমে দ্রুত বাড়ির পথে হাঁটা যাত্রীদের কেউ কেউ চিৎকার চেঁচামিচি শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। পর মুহূর্তেই কী হচ্ছে তা বুঝতে পেরে আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়েন।
কথা হচ্ছিল স্টেশনে আশ্রয় নেওয়া পঞ্চাশোর্ধ বলদি সাউয়ের সঙ্গে। তিনি জানান, সারা দিন ট্রেনে ঘুরে ভিক্ষা করেন। রাতে দুর্গাপুর স্টেশনে এসে শুয়ে পড়েন। কত দিন ধরে তিনি এই ‘রুটিন’ অনুসরণ করছেন, মনে করে বলতে পারলেন না। কিন্তু দুর্গাপুর স্টেশন কেন? তিনি জানালেন, এখানে যাত্রীর সংখ্যা কম। আশপাশও একটু ঘেরা। ফলে বর্ষায় বা শীতে কষ্ট কম হয়। কিন্তু এ ভাবে রাত ৯টা বাজতে না বাজতেই স্টেশন চত্বর জুড়ে শুয়ে পড়লে যাত্রীদের আসা-যাওয়ার সমস্যা হয় না? বিভূতি এক্সপ্রেস ধরে কলকাতা থেকে ফেরার পথে বিধাননগরের দীনেশ ঠাকুর বললেন, ‘‘কিছু তো করার নেই। মানবিকতার ব্যাপার। যেদিকটা ফাঁকা থাকে সেদিক দিয়ে বেরিয়ে আসি।’’
কী বলছে পুরসভা?
এমনিতেই আধুনিক শিল্প শহরে এমন নিরাশ্রয় ভবঘুরে থাকা বেমানান। তার তার উপর কেন্দ্রীয় সরকারের স্মার্ট সিটি প্রকল্পে এই শহরের নাম রয়েছে। স্মার্ট সিটি হতে গেলে এমন মানুষজনের রাতে থাকার উপযুক্ত আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। তা না হলে এই প্রকল্পের শর্ত পূরণ হবে না। সে ক্ষেত্রে ভবঘুরেদের জন্য ভবন তৈরিই একমাত্র পথ। পুরসভার ডেপুটি মেয়র অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ‘ন্যাশনাল আরবান লাইভলিহুড মিশন’ (এনআরএলএম) প্রকল্পের আওতায় শহরে একটি ৫০ শয্যার ভবঘুরেদের ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গিয়েছে। দ্রুত কাজ শুরু হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অমিতাভবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy