Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বিল্বগ্রামে তৃণমূল নেতা খুনে জনরোষ, ভাঙচুর

‘রাজনীতি করে কী পেল ও’

সেই রোষের জেরেই অভিযুক্তদের অনেকের বাড়িতে বৃহস্পতিবার সাতসকালেই ভাঙচুর চালায় উত্তেজিত জনতা। তাঁদের মধ্যে রয়েছে খেলারাম বাগদি নামে এক ত়ৃণমূল কর্মী এবং বিল্বগ্রাম পঞ্চায়েতে জয়ী তৃণমূল সদস্য শিখা বাগদির বাড়ি।

রোষ: তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর। (ইনসেটে) জখম তৃণমূলকর্মী।— নিজস্ব চিত্র।

রোষ: তৃণমূল কর্মীর বাড়িতে ভাঙচুর। (ইনসেটে) জখম তৃণমূলকর্মী।— নিজস্ব চিত্র।

কাজল মির্জা
বিল্বগ্রাম (আউশগ্রাম) শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ০১:৩২
Share: Save:

রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই দলের বিল্বগ্রাম অঞ্চল সভাপতি পদে ছিলেন উজ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়। দলের ভাল কর্মী সুনাম ছিল তাঁর। সিপিএমের প্রবল দাপটের সময় এলাকায় সংগঠন বাড়ানোয় তাঁর ভূমিকার কথা মানেন স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা। তাঁদের দাবি, উজ্জ্বলের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিও ছিল সৎ। এ হেন নেতাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুনের ফলেই এলাকায় জনরোষ ছড়িয়েছে বলে জানাচ্ছেন নিচুতলার কর্মীদের একাংশ।

সেই রোষের জেরেই অভিযুক্তদের অনেকের বাড়িতে বৃহস্পতিবার সাতসকালেই ভাঙচুর চালায় উত্তেজিত জনতা। তাঁদের মধ্যে রয়েছে খেলারাম বাগদি নামে এক ত়ৃণমূল কর্মী এবং বিল্বগ্রাম পঞ্চায়েতে জয়ী তৃণমূল সদস্য শিখা বাগদির বাড়ি। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘উজ্জ্বলদাকে যে এমন ভাবে খুন করা হতে পারে, কোনও দিন কল্পনাতেও আনিনি!’’ যে ভাবে এই খুন হয়েছে, তাতে পূর্ব পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট বলে দাবি করেছেন ওই তৃণমূলকর্মীরা এবং নিহতের পরিবারের লোকজন।

বুধবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে, বনপাশ স্টেশন লাগোয়া এক চায়ের দোকানে সঙ্গীদের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছিলেন উজ্জ্বল। পাশেই তাঁর ভাই সজলের মনোহারির দোকান। হামলায় আহত তৃণমূল কর্মী মনা বাগদি বলেন, ‘‘আচমকাই বেশ কয়েকটা মোটরবাইকে জনা পনেরো দুষ্কৃতী হাজির হয়। ওদের হাতে ছিল লোহার রড, লাঠি, বোমা। প্রথমেই ওরা বোমা ছুড়তে শুরু করে। ভয়ে আমরা বেশির ভাগই ছুটে পালাই। আমার কপালে রডের আঘাত লাগে। কোনও মতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাই।’’

কিন্তু, দুই পায়ে স্টিলের পাত থাকায় পালাতে পারেননি উজ্জ্বল। তাঁকে রড-লাঠি দিয়ে পেটানোর পাশাপাশি ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সুপ্রিয় রায় নামে উজ্জ্বলের এক প্রতিবেশী তার কিছু পরেই বর্ধমান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি, মনা-সহ কয়েক জন মিলে উজ্জ্বলকে বর্ধমান মেডিক্যালে নিয়ে যান। সেখান থেকে তাঁকে এসএসকেএমে রেফার করা হয়। পথেই তিনি মারা যান। এ দিন বর্ধমান মেডিক্যালে তাঁর দেহের ময়নাতদন্ত হয়।

বিল্বগ্রামে মাটির দোতলা ছোট বাড়ি উজ্জ্বলদের। দুই ভাই ও অশীতিপর মাকে নিয়ে সংসার। তিন ভাই-ই অকৃতদার। চার বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। চাষবাস করেই দিন চলে তাঁদের। বাড়ির ভিতরে একটি ও বাইরে একটি গোয়াল ঘর। সেখানে ২৫-২৬ টি গরু। বুধবার সারা রাত উজ্জ্বল না ফেরায় খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন তাঁর মা অণিমাদেবী। এ দিন সকাল অবধি তাঁকে কেউই ছেলের মৃত্যুসংবাদ দিতে পারেননি। বৃহস্পতিবার সকালে বেশ কয়েক বার ছেলের খোঁজে নিজেই বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু, মেয়ে-জামাইরা যখন একে একে বাড়িতে আসতে শুরু করলেন, তখনই বুক ছ্যাঁত করে উঠেছিল ওই বৃদ্ধার। শেষে বড় ছেলের খুন হওয়ার খবর পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বারবার বলছিলেন, ‘‘একবার ফিরে আয়। গাছ পাকা আম খাবি বলেছিলি। ফিরে আয়, গাছের আম পাড়ব।” বাড়ির উঠোনে জটলা করে থাকা প্রতিবেশীদেরও চোখের জলও বাঁধ মানেনি।

নিহতের জামাইবাবু সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘এই খুন মেনে নেওয়া যায় না। এক মাস আগে ও আমার বাড়িতে গিয়েছিল। আমি তখন ওকে রাজনীতি ছেড়ে দিতে বলেছিলাম। কী পেল ও রাজনীতিতে? প্রাণটাই খোয়াতে হল!”

তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, অঞ্চল সভাপতি হলেও ধীরে ধীরে বিল্বগ্রাম পঞ্চায়েতের উপরে রাশ আলগা হচ্ছিল উজ্জ্বলের। ক্ষমতা বাড়ছিল জয়দেব মণ্ডলের। মাঝমধ্যে দুই গোষ্ঠীর সংঘাত বাধলেও বড় মাপের সংঘর্ষ কখনও হয়নি। উজ্জ্বলের ভাগ্নে, পেশায় আউশগ্রাম থানার সিভিক ভলান্টিয়ার অতীন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, জয়দেব ভোটের আগে নিজেকে অঞ্চল সভাপতি হিসাবে প্রচার করেছিলেন। সেই নিয়েও দু’পক্ষের বিবাদ বেধেছিল। কিন্তু, নেতৃত্ব জানিয়ে দেন, উজ্জ্বলই দায়িত্বে। নিহত নেতার ভাই শীতল চট্টোপাধ্যায়ের আবার অভিযোগ, “দলের একটা অংশের তোলাবাজির বিরুদ্ধে দাদা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই উনি ওই অংশের চক্ষুশূল হন। সেই আক্রোশেই খুন করা হয়েছে বলে আমাদের ধারণা।”

আউশগ্রাম ১ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি শেখ সালেকের (টগর) যদিও দাবি, “গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে উজ্জ্বল খুন হননি। তাকে সিপিএমের দুষ্কৃতীরা খুন করেছে।” একই বক্তব্য আউশগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা অনুব্রত মণ্ডলের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC TMC Leader
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE