জি টি রোডের একপাশে বছরভর এ ভাবেই পড়ে থাকে রথ।—নিজস্ব চিত্র।
হরেক গল্পগাথা আর অসংখ্য স্মৃতি নিয়ে মাহেশের রথযাত্রা আস্ত এক ইতিহাস। রাজ্যের হেরিটেজের তালিকায় অবশ্য অবহেলিতই থেকে গিয়েছে মাহেশ। এমনকী রাজ্যের পর্যটন কেন্দ্রের তালিকাতেও ঠাঁই হয়নি তার। মাহেশ তথা শ্রীরামপুরবাসীর সেই ক্ষোভ নিয়েই আগামীকাল ফের টান পড়বে রথের রশিতে।
ইতিহাস বলছে, পুরীতে যাওয়ার পথে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন চৈতন্যদেব। পুরীকে বলা হয় নীলাচল। চৈতন্যদেব মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ আখ্যা দেন। প্রাচীনতায়, ঐতিহ্যে পুরীর পরেই মাহেশের স্থান। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারানী’ উপন্যাসে মাহেশে রথের মেলার উল্লেখ আছে। এই রথযাত্রায় এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই রথযাত্রা এ বার ৬১৮ বছরে পা দিল। মন্দির কর্তৃপক্ষের অনুযোগ, বহু বছর ধরেই মাহেশের রথ, মন্দির, মাসির বাড়িকে ঘিরে হেরিটেজ অথবা পর্যটন কেন্দ্র করার আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। কয়েক বছর আগে (বাম আমলে) শ্রীরামপুরের তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক রত্না দে নাগ রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন মাহেশকে হেরিটেজ ঘোষণার আবেদন জানিয়ে। যাবতীয় চিঠি-চাপাটি অবশ্য ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে থেকেছে। কিন্তু শিকে ছেঁড়েনি মাহেশের ভাগ্যে। হেরিটেজ বা পর্যটন কেন্দ্র দূরঅস্ত, হুগলি জেলা প্রশাসনের সরকারি ওয়েবসাইটেও দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবে ঠাঁই মেলেনি মাহেশের।
মন্দিরের প্রধান সেবাইত সৌমেন অধিকারীর ক্ষোভ, “এই রথযাত্রা বহু মনীষী এবং রাজার স্মৃতিধন্য। কিন্তু কী কারণে সরকারি স্তরে মাহেশ এতটা বঞ্চিত, তা বোধহয় কেবল জগন্নাথই জানেন।” ঘটনা হচ্ছে, পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত, শৌচাগার, যাত্রীনিবাস মাহেশে কার্যত এ সবের কিছুই নেই। ফলে, রথে লক্ষ লক্ষ পূণ্যার্থী সমস্যায় পড়েন। সোজা রথ এবং উল্টো রথের দু’দিন বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা রাজনৈতিক দল জলসত্রের ব্যবস্থা করে। কিন্তু শৌচাগার না থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা মহিলারা সমস্যায় পড়েন। শ্রীরামপুরের বর্তমান বিধায়ক সুদীপ্ত রায় দিন কয়েক আগে বিধানসভায় চলতি অধিবেশনে বিষয়টি তোলেন। সুদীপ্তবাবু বলেন, “মাহেশ সত্যিই বঞ্চিত। জায়গাটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে রাজ্য যাতে ঘোষণা করে, আমি সেই দাবি রেখেছি। ভবিষ্যতেও এ ব্যাপারে চেষ্টা করে যাব। হেরিটেজ করার ব্যাপারেও চেষ্টা করব।”
কথিত আছে, ৬১৮ বছর আগে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে জগন্নাথদেবের এক ভক্ত পুরীতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে জগন্নাথের দর্শন না পেয়ে দুঃখে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন। পরে ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে এসে গঙ্গার ধারে বসেছিলেন। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার এক রাতে গঙ্গায় ভাসমান একটি নিমকাঠ পান ধ্রুবানন্দ। ওই নিমকাঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সেই বিগ্রহই আজও পুজিত হচ্ছে। সেই সময় গঙ্গার ধারে (বর্তমানে লক্ষ্মীঘাট) তৈরি হয় মন্দির। মন্দিরের সামনে থেকে গঙ্গার ধার ঘেঁষে রথ চলত চাতরায় গুন্ডিচাবাটি পর্যন্ত। রথটি তৈরি করে দিয়েছিলেন এক মোদক। ১৭৫৪ সালে রথযাত্রায় এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি জেলার দেওয়ান শ্যামবাজারের বসু পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু। তিনি রথের ব্যয়ভার বহনের প্রতিশ্রুতি দেন। পরের বছর তিনি পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট কাঠের রথ তৈরি করে দেন। রথ চলাচলের জন্য মাহেশ থেকে বল্লভপুর পর্যন্ত দেড় মাইল রাস্তাও তৈরি করে দেন। তখন থেকেই ওই পরিবার রথের দায়িত্ব নিয়ে আসছেন। বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করেন কৃষ্ণরামবাবুর বন্ধু, কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা নিবাসী নয়নচাঁদ মল্লিক। সেই সময় বল্লভপুর পর্যন্ত রথ যেত। রাস্তার দু’ধার মেলা বসত।
সময়ের সঙ্গে সেই রথ জীর্ণ হয়ে পড়ে। কৃষ্ণরামের ছেলে গুরুপ্রসাদ ১৭৯৮ সালে নয় চূড়াবিশিষ্ট নতুন রথ বানিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটিতে সেই রথটি আগুনে পুড়ে যায়। তখন বসু পরিবারেরই কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দেন। মার্টিন বার্ন কোম্পানি রথটি তৈরি করে। সেই সময়েই এর দাম পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। ১৮৮৫ সাল থেকে ওই রথে টান শুরু হয়। সেই থেকেই ১২৮ বছর ধরে এক ভাবে ওই রথ চলছে। চার তলবিশিষ্ট রথটি সম্পূর্ণ লোহার কাঠামোর উপর কাঠ দিয়ে তৈরি। উচ্চতা ৫০ ফুট। ওজন ১২৫ টন। ১২টি লোহার চাকা রয়েছে। এক একটি চাকার বেড় ১ ফুট। চার তলায় দেবতাদের বিগ্রহ বসানো হয়। তামার দু’টি ঘোড়া রথের সামনে লাগানো হয়। ঘোড়া দু’টি তৈরি করে দিয়েছিল একটি বিদেশি সংস্থা।
স্নানযাত্রার দিন প্রচুর দুধ-গঙ্গাজলে স্নান করে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার জ্বর আসে। আরামবাগ, গোঘাট এবং ঘাটাল থেকে তিন জন কবিরাজ আসেন। তাঁদের দেওয়া পাঁচনে ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন তাঁরা। রথযাত্রার এক দিন আগে রাজা হিসেবে অভিষেক হয় জগন্নাথের। সোজা রথের দিন রথে চাপিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় গুন্ডিচাবাটিতে। মাহেশে গুণ্ডিচাবাটিকে বলা হয় কুঞ্জবাটী বা মাসির বাড়ি। অনেকে ভাবেন রথে চেপে জগন্নাথ তাঁর মায়ের বোন মাসির বাড়িতে আসেন। আসলে জগন্নাথ সখী পৌর্ণমাসির কুঞ্জে যান। অস্যংখ্য ভক্ত রশি টেনে রথকে জিটি রোড ধরে মাসির বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন। রথ চালানোর জন্য বিউগল কাসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। থামানোর জন্য বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy