Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

ধর ধর, ওই চোর, ওই চোর!

পুলিশকে খবর না দিয়ে কেন এমন ভাবে মারধর করা হল ওই যুবককে? প্রশ্নের উত্তরে এলাকার বাসিন্দা অসিত দত্তের জবাব, ‘‘দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল। সামান্য মারধর করে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। পরে আমরাই পুলিশকে খবর দিয়ে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’’

লাঠি দিয়ে বাপিকে বেধড়ক মারধর স্থানীয়দের। বৃহস্পতিবার, হাওড়ার শ্রীবাস দত্ত লেনে। নিজস্ব চিত্র

লাঠি দিয়ে বাপিকে বেধড়ক মারধর স্থানীয়দের। বৃহস্পতিবার, হাওড়ার শ্রীবাস দত্ত লেনে। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৪২
Share: Save:

নাইলনের দড়ি দিয়ে এক যুবকের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। কয়েক জন ব্যক্তি ধরে রেখেছেন সেই দড়ি, যাতে ওই যুবক পালাতে না পারেন। আর লাঠি, বাঁশ, রড দিয়ে ওই যুবককে বেধড়ক মারধর করছে কয়েক জন স্থানীয় বাসিন্দা। যন্ত্রণায় ওই যুবক কুঁকড়ে গিয়ে চিৎকার করলেও এলোপাথাড়ি মারধরে বিরাম নেই। সবটাই স্রেফ সন্দেহের বশে। বৃহস্পতিবার সকালে, হাওড়া থানা এলাকার শ্রীবাস দত্ত লেনে এ ভাবেই চোর সন্দেহে বাপি প্রসাদ নামে এক যুবককে গণপিটুনি দেওয়ার ঘটনা ঘটল।

এই ঘটনায় এক সময়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তাতেই লুটিয়ে পড়েন ওই যুবক। মারধরের চোটে তাঁর মুখ ফেটে যায়, শরীরের একাধিক জায়গা থেকে রক্ত বেরোতে থাকে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাঁকে উদ্ধার করে হাওড়া জেলা হাসপাতালে ভর্তি করে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, মারধরের জেরে ওই যুবকের নাক দিয়ে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। একাধিক জায়গায় আঘাত গুরুতর। এই ঘটনা নিয়ে হাওড়া এসিপি (দক্ষিণ) গুলাম সারোয়ার বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তল্লাশি অভিযান চলছে।’’

এলাকার কয়েক জন বাসিন্দা ঘটনার ছবি তুলেছিলেন। দুপুরের আগেই ‘ভাইরাল’ হয়েছে সেই ছবি। যারা অভিযুক্ত, তারা অধিকাংশই এলাকার বাসিন্দা। প্রশ্ন উঠেছে, তার পরেও কেন পুলিশ তাদের ধরতে পারল না? এসিপি-র কাছে এই প্রশ্নের কোনও নির্দিষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি।

পুলিশ সূত্রের খবর, ওই এলাকায় বেশ কিছু দিন ধরে কয়েকটি বাড়ি থেকে মোবাইল, বাসন, গ্যাস ওভেন, বার্নার চুরি যাচ্ছিল বলে স্থানীয়েরা অভিযোগে জানিয়েছেন। এ দিন ভোরে সমর দাস নামে এক ব্যক্তির বাড়ির শৌচাগার থেকে হাতেনাতে পাকড়াও করা হয় বাপিকে। চুরি করতে গিয়েই ওই শৌচাগারে বাপি লুকিয়ে ছিলেন বলে সন্দেহ করেন সমরবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘দিন চার-পাঁচ আগে বাড়ি থেকে জিনিসপত্র চুরি গিয়েছিল। এ দিন ভোরে শব্দ পেয়ে শৌচাগারে গিয়ে দেখি, ওই যুবক সেখানে লুকিয়ে রয়েছে। ওকে ধরে ফেলে ওর পকেট হাতড়ে নিজের মোবাইল উদ্ধার করি। আমার তালা-চাবিও পাই।’’ এর পরে বাড়িতেই ওই যুবককে আটকে রেখে পুলিশকে খবর দেওয়ার বদলে পাড়ার লোকজনকে ডেকে পাঠান সমরবাবু।

আর এক স্থানীয় বাসিন্দা বিশ্বনাথ সিংহরায় জানান, এ দিন তাঁর ঘর থেকেও বাসনপত্র চুরি গিয়েছে। তাই খবর পেয়ে তাঁরও ধারণা হয়, আটকে রাখা ওই যুবকই চুরি করছে। ফলে পাড়ার লোকেদের সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ে বাপির উপরে। দোহারা চেহারার ওই যুবককে দড়ি দিয়ে বেঁধে শুরু হয় বেধড়ক মারধর। পাড়ার ভিতরে মারতে মারতে ক্রমশ তাঁকে গলির বাইরে নিয়ে গিয়ে বাতিস্তম্ভের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। তার পরেও চলে গণপিটুনি। মারধরের জেরে এক সময়ে রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন বাপি। দিনের আলোয় প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটলেও বাধা দিতে এগিয়ে আসেননি কেউই। পরে পুলিশকে স্থানীয়েরা জানিয়েছেন, বাপির মুখ তাঁদের পরিচিত। তবে তাঁর বাড়ি কোথায়, তা এখনও সঠিক ভাবে জানতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশকে খবর না দিয়ে কেন এমন ভাবে মারধর করা হল ওই যুবককে? প্রশ্নের উত্তরে এলাকার বাসিন্দা অসিত দত্তের জবাব, ‘‘দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ছিল। সামান্য মারধর করে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। পরে আমরাই পুলিশকে খবর দিয়ে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।’’

প্রসঙ্গত, গত মাসেও হাওড়ার বেলগাছিয়া এলাকায় চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছিল। সে ক্ষেত্রেও পুলিশকে খবর না দিয়েই ধৃত যুবককে বেধড়ক মারধর করেছিলেন স্থানীয়েরা। কেন বারবার ঘটছে এমন ঘটনা? মনোবিদ মোহিত রণদীপের মতে, পুলিশের উপরে আস্থার অভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষের মনের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ-বিদ্বেষ এ ভাবেই বাইরে বেরিয়ে আসে। অনেকেই মনে করেন, যে মারধর করাটাই আমার অধিকার। এ ছাড়া এই সব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তেরা ছাড় পেয়ে যান। তাই গণপিটুনির ঘটনা বেড়েই চলেছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lynching Mob Psychology
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE