Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘কাজে গিয়ে বেতন-খাবার-জল না পেয়ে দিন কাটাতে হবে, কে জানত!’

ভেবেছিলাম, একবার ভাগ্যটা পরখ করেই দেখি। ভাগ্য ভাল হলে সংসারে আর অভাব থাকবে না। কাজটাও তো জানা। সেই তো সোনার কাজ। কিন্তু সেখানে যে বেতন না-পেয়ে, খাবার না-পেয়ে, জল না-পেয়ে দিন কাটাতে হবে, কে জানত!

সাক্ষাৎ: ইরান থেকে হুগলির পান্ডুয়ায় নিজের বাড়িতে ফিরে বাবার সঙ্গে এক শ্রমিক শেখ রহিম। ছবি: সুশান্ত সরকার

সাক্ষাৎ: ইরান থেকে হুগলির পান্ডুয়ায় নিজের বাড়িতে ফিরে বাবার সঙ্গে এক শ্রমিক শেখ রহিম। ছবি: সুশান্ত সরকার

শেখ রহিম
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:৩০
Share: Save:

অনেকদিন পরে বুধবার রাতে শান্তিতে ঘুমোলাম।দুশ্চিন্তা নেই। খাবারের ভাবনা নেই। নিজের বিছানা। নিজের ঘর। পাশে বাবা-মা, পাড়া-পড়শি। আর গত ১৫ দিনের কথা ভাবতে চাইছি না। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে যে বিপদে পড়ব, কে জানত!

পান্ডুয়ার জায়ের গ্রামে আমাদের সাধারণ পরিবার। বাবা দিনমজুরের কাজ করেন। মাঝেমধ্যে অন্যের জমিতে চাষাবাদ। দাদা দু’বছর ধরে দুবাইয়ে সোনার কাজ করছে। আমি ক্লাস ফাইভ পাশ। ষষ্ঠ শ্রেণির মাঝপথে পড়া ছেড়ে সুরাতে সোনার কাজ শিখতে যাই। দু’বছর ওখানে কাজ শিখেছি। ফিরে এসে কিছুদিন বাড়িতে বেকার বসেছিলাম। তারপরে মোটরভ্যান চালিয়েছি। লোকের জমিতে কাজ করেছি। এ বছরের গোড়ার দিকে পোলবার এক পরিচিত যখন ইরানে মোটা বেতনের কাজের প্রস্তাব দেয়, না করতে পারিনি। ভেবেছিলাম, একবার ভাগ্যটা পরখ করেই দেখি। ভাগ্য ভাল হলে সংসারে আর অভাব থাকবে না। কাজটাও তো জানা। সেই তো সোনার কাজ। কিন্তু সেখানে যে বেতন না-পেয়ে, খাবার না-পেয়ে, জল না-পেয়ে দিন কাটাতে হবে, কে জানত!

বাবা প্রথমে নিমরাজি ছিলেন। পরে ইরানে যাওয়ার অনুমতি দেন। পোলবার সেই পরিচিতকে প্রায় ৪০ হাজার টাকা দিয়ে কাজটা জোগাড় করলাম। ৭ মার্চ, বুধবার রাতে কলকাতা থেকে যখন দিল্লির প্লেনে চড়ি, তখন বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল। আমার প্রথম প্লেনে চড়া। দিল্লি থেকে পরের দিন সকালে ইরানের তেহরানে গিয়ে নামি। এয়ারপোর্ট থেকে বাসে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লগেছিল কর্মস্থল চাবাহারে পৌঁছতে। আমরা এ রাজ্য থেকে একসঙ্গে ২৬ জন গিয়েছিলাম। তার মধ্যে পান্ডুয়ারই চার জন।

১২ মার্চ থেকে কাজ শুরু করি। থাকতাম কারখানার ঘরেই। একসঙ্গে ছ’জন। কাজের সময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা, আবার বেলা ২টো থেকে রাত ৮টা। মাসে ২৭ হাজার টাকা মাইনে (ভারতীয় মুদ্রায়)। তার মধ্যে ৪৫০০-৫০০০ টাকা (ভারতীয় মুদ্রায়) দিতে হত খাবার ও পানীয় জলের জন্য। সে সব অবশ্য কারখানার ক্যান্টিনেই মিলত। তবে রান্না পালা করে আমাদেরই করতে হত।

বেশ চলছিল। কিন্তু জুন মাসের পরই বেতন বন্ধ হয়ে যায়। ভেবেছিলাম, হয়তো সাময়িক কোনও সমস্যা চলছে কারখানায়। ক্যান্টিন চালু ছিল। সময়মতো খাবার, জল পাচ্ছিলাম। তাই বেশি ভাবিনি। কিন্তু কিছুদিন পরে কাজও বন্ধ হয়ে যায়। কারখানার কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতেন না। এ বার নিজেদের সঞ্চয়ে হাত পড়ল। প্রায় তিন মাস নিজেদের জমানো টাকাতেই খাবার কিনে চালাচ্ছিলাম। কিন্তু সেই টাকায় আর কতদিন চলে! কয়েকজনের টাকা তো শেষই হয়ে গেল। শেষ ১৫দিন তো নিজেদের মধ্যেই ধার করা শুরু করলাম। সামান্য কেনা খাবার আর কেনা জল দিয়েই আমরা ছ’জন চালাচ্ছিলাম। দু’এক দিন নির্জলাও কাটাতে হয়েছে।

পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপ হতো, যদি না মোবাইল থাকত। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে, সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে কিছুটা সাড়া পেলাম। ২৫ অক্টোবর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। বুধবার ওই সংস্থার সাহায্যেই ফিরলাম। ফেরার সময়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের সকলের বকেয়া বেতন দিয়ে দিয়েছেন। এটা ভাল লাগছে।

এ বার এলাকাতেই কাজ খুঁজব। না হলে বাবার সঙ্গে আবার মাঠে নামব। উপার্জন হয়তো কম হবে। কিন্তু বিপদ তো থাকবে না!

(ইরান থেকে ফেরা পান্ডুয়ার যুবক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Iran Indian Labour Job Offer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE