Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
কেন যে হাসপাতালে গেলাম না, আক্ষেপ মায়ের

সাপের ওঝার ঝাড়ফুঁকে মৃত কিশোরী

হাসপাতাল খুব দূরে ছিল না। তবু সাপে কাটা মেয়েকে নিয়ে ‘চিকিৎসা’র জন্য ওঝার কাছে ছুটেছিলেন মা। ওঝা নানা টোটকা দিয়ে মেয়েটি ‘সুস্থ’ হয়ে গিয়েছে দাবি করেছিল। বছর পনেরোর মেয়েটিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও আর শেষ রক্ষা হয়নি।

মৃত সপ্তমী ঘরামি (বাঁ দিকে) অভিযুক্ত ওঝা প্রদীপ মণ্ডল (ডান দিকে)

মৃত সপ্তমী ঘরামি (বাঁ দিকে) অভিযুক্ত ওঝা প্রদীপ মণ্ডল (ডান দিকে)

প্রকাশ পাল ও সুশান্ত সরকার
ডুমুরদহ শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৩৮
Share: Save:

হাসপাতাল খুব দূরে ছিল না। তবু সাপে কাটা মেয়েকে নিয়ে ‘চিকিৎসা’র জন্য ওঝার কাছে ছুটেছিলেন মা। ওঝা নানা টোটকা দিয়ে মেয়েটি ‘সুস্থ’ হয়ে গিয়েছে দাবি করেছিল। বছর পনেরোর মেয়েটিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও আর শেষ রক্ষা হয়নি।

বুধবার হুগলির বলাগড়ের ডুমুরদহের এই ঘটনায় মৃতের নাম সপ্তমী ঘরামি। মেয়ের মৃত্যুর পর মা অঞ্জনাদেবীর আক্ষেপ, ‘‘এখানে সাপে কাটলেই সবাই ওঝার কাছে যায়। ওঝার উপর ভরসা না করে আগেই হাসপাতালে নিয়ে গেলে মেয়েটা বেঁচে যেত।’’

সপর্দষ্ট রোগীকে সুস্থ করতে যে চিকিৎসার প্রয়োজন, তা নিয়ে প্রশাসনের সচেতনতা প্রচার চলছেই। স্কুল-কলেজ-গ্রামে প্রতিনিয়ত গান, কবিতার মাধ্যমে প্রচার চালানো হচ্ছে। তারপরও যে মানুষ সচেতন হচ্ছেন না, এ দিনের ঘটনাই তার প্রমাণ।

মৃত সপ্তমী ঘরামির বাবা হরবিলাস ঘরামি খেতমজুর আর মা অঞ্জনাদেবী গৃহবধূ। বুধবার সকালে হরবিলাস কাজে বেরিয়ে ছিলেন। আর অঞ্জনাদেবী ঋণের টাকা শোধ করতে কাছেই একটি বাড়িতে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ধ্রুবানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী সপ্তমী এ দিন ভাইয়ের সঙ্গে চৌকির উপরে ঘুমোচ্ছিল। সকাল ৮টা নাগাদ বিছানায় উঠে একটি সাপ তাকে ছোবল মারে। বিষয়টি জানাজানি হতেই হরবিলাসকে ফোন করা হয়।

প্রতিবেশীর কথায়, ‘‘হরবিলাস বলে, যেন মেয়েকে স্থানীয় এক ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সপ্তমীর মা আর এলাকার কয়েকজন সপ্তমীকে ওঝার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।’’

অঞ্জনাদেবীর দাবি, ওঝা মেয়ের বাঁধন খুলে ঝাঁড়ফুক করেন‌। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে ওঝা বলেন, তার দরকার নেই। মেয়ে ভাল হয়ে গিয়েছে। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে থোড়ের রস খাওয়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়। সপ্তমীকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। আধঘণ্টা পরেই সে বমি করতে শুরু করে। হাত-পা কাঁপতে থাকে। তখন ওঝাকে বিষয়টি জানালে তিনি মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ চুঁচুড়া ইমামবাড়া হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই কিশোরী মার যায়।

ইতিমধ্যে অবশ্য হরবিলাসবাবু দ্বারস্থ হয়েছিলেন অন্য এক ওঝার। সেখান থেকে ‘ওষুধ’ নিয়ে তিনি হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, মেয়ে মারা গিয়েছে।

এই বিছানাতেই সাপে ছোবল মারে সপ্তমীকে। নিজস্ব চিত্র

ওঝা প্রদীপ মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘সাপে কাটলে পেট গরম হয়, মাথায় রক্ত উঠে যায়। থোড়ের রস খাওয়ালে তা ভাল হয়ে যায়।’’ দৈবশক্তিতে রোগ ভাল হলে হাসপাতালে পাঠানোর দরকার কেন পড়ে? ওঝার ব্যাখ্যা, ‘‘যার যে ভাবে মৃত্যু হওয়ার, হবেই। বিধাতার লিখন রোধ করা যায়!’’

বিডিও (বলাগড়) সমিত সরকার বলেন, ‘‘সম্প্রতি স্কুল পর্যায়ে প্রচার করা হয়েছে। ফের করা হবে।’’ জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের দাবি, সমস্ত গ্রামীণ হাসপাতালে সর্পদষ্টের চিকিৎসা হয়। সময় নষ্ট না করে সর্পদষ্টকে হাসপাতালে যেতে প্রচারও চা‌লানো হয়। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য কাউন্সিলের সদস্য চন্দন দেবনাথ বলেন‌, ‘‘ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে মেয়েটির ক্ষতি হয়েছে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, বাঁচানো যেত। ওঝার ঝাঁড়ফুক যে বুজরুকি, তা নিয়ে প্রচারের চেষ্টা করব।’’ তবে ওই ওঝার বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নিয়ে মুখো খোলেননি কেউ।

এ দিন ওই ছাত্রীর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। শোকপ্রকাশের সময় সর্প দংশনের চিকিৎসা নিয়ে পড়ুয়াদের সচেতন করেন শিক্ষকরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Snake Bite Shaman Superstition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE