প্রত্যক্ষদর্শী: শনিবার বিকেলে দুর্ঘটনার পর শ্রীরামপুরে। ছবি: প্রকাশ পাল
শ্রীরামপুর স্টেশনের কাছে শনিবার বিকেলে ট্রেন দুর্ঘটনার খবরটা অফিসে বসেই পেয়েছিলাম। কিন্তু তার জেরে যে রাত প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ভুগতে হবে, কল্পনা করিনি। এক রকম প্রাণ হাতে করেই বাড়ি ফিরি। অনেক যাত্রী তো মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বাড়ি ফিরতে পারেননি। এই অভিজ্ঞতা জীবনে ভুলব না।
আট বছর ধরে কলকাতার ডালহৌসিতে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করি। বাড়ি বৈঁচিতে। কাজে যাতায়াতের সুবিধার জন্য চুঁচুড়া স্টেশনের কাছে ফার্ম সাইড রোডে ভাড়া থাকি। সকাল ৯টার ট্রেনে অফিসে যাই। সাধারণত হাওড়া থেকে রাত ৮টা ২০ মিনিটের ‘গ্যালপিং লোকাল’ ধরে ফিরি। শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় ছুটি। এই দিনগুলোয় ৭টার ‘বর্ধমান সুপার’-এ ফিরি। ভেবেছিলাম, এ দিন দুর্ঘটনার জন্য হয়তো কিছুটা ভোগান্তি হবে। ট্রেন দেরি করে ছাড়বে। কিন্তু এত দেরি!
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছই ৬টা ৪০ নাগাদ। থিকথিকে ভিড়। ১ থেকে ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন নেই। শুধু দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। ট্রেনের খোঁজে বারবার চোখ যাচ্ছিল ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে। সওয়া ৭টায় তারকেশ্বর লোকাল দিল। ওই ট্রেনে শ্রীরামপুর বা শেওড়াফুলি পর্যন্ত পৌঁছনো যেত। কিন্তু এত ভিড়, ওঠার চেষ্টাই করিনি। আধঘণ্টা পরে একটা গোঘাট লোকাল ছাড়ল। সেটারও একই অবস্থা। এর পরে ঘোষণা হল—‘গয়া এক্সপ্রেস সব স্টেশনে থামবে’। অন্যদিন ট্রেনটির প্রথম ‘স্টপ’ থাকে ব্যান্ডেলে। সেই ট্রেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩৫ মিনিট দেরিতে ছাড়ল। সেখানেও তিল ধারণের জায়গা ছিল না। তাই উঠিনি।
ততক্ষণে দুন এক্সপ্রেস ঢুকেছে। এই ট্রেনটা চন্দননগরে থামে। কপাল ঠুকে উঠে পড়ি। এই ট্রেনেও এত ভিড় যে কোনও রকমে দরজার রড ধরে পা দু’টো কামরায় রাখতে পারলাম। ট্রেন ছাড়ল ৯টা ৫ মিনিটে। গয়ার মতো ঘোষণা না থাকলেও দুন এক্সপ্রেসও সব স্টেশনে থামছিল। প্রতি স্টেশনে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে। তাঁদের ট্রেনে ওঠার জো নেই। ঝুলতে ঝুলতেই লিলুয়া, বেলুড়, বালি পৌঁছলাম। মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মতো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। ভিজে একসা। রড ধরে আর এগোনো যাচ্ছিল না। দমবন্ধ অবস্থা। ভয় লাগছিল, পোস্টে ধাক্কা খেয়ে পড়ে না যাই। ভাবলাম, আগে প্রাণটা বাঁচাই। উত্তরপাড়া স্টেশনে নেমে পড়লাম। ঘড়ির কাঁটা ১০টা পেরিয়ে গিয়েছে।
আধ ঘণ্টা পরে একটা লোকাল গেল। সেটাতেও উঠতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত একটা বর্ধমান লোকালে উঠলাম কোনওক্রমে। রিষড়ায় একটু ভিতরে ঢোকার জায়গা পেলাম। অতি ধীর গতিতে ট্রেন চলছিল। চুঁচুড়ায় নামলাম প্রায় সাড়ে ১১টায়। গোটা রাস্তায় বাবা-মা, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন উদ্বিগ্ন হয়ে ক্রমাগত ফোন করেছেন। ট্রেনের নিত্যযাত্রী হিসেবে কঠিন পরিস্থিতিতে আগেও পড়েছি। কিন্তু এমন দশা হয়নি। শ্রীরামপুরে দুর্ঘটনা ঘটেছে রেলের গাফিলতিতে। সাময়িক সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু মাঝরাত পর্যন্ত এমন ভোগান্তি? শ্রীরামপুর তো কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের সিঙ্গল লাইনের স্টেশন নয়। চারটি লাইন রয়েছে। দু’টিতে সমস্যা থাকলেও অন্য দু’টো স্বাভাবিক ছিল। তা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেল না?
আমাদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ট্রেন। এখন কোনও ট্রেন সময়সূচি মেনে চলে না। নির্ধারিত সময়ের থেকে দশ-পনেরো মিনিট দেরিতে ট্রেন চলাটা যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। অফিসের ব্যস্ত সময়ে ট্রেনে কী পরিমাণ ভিড় হয় এবং ভিতরে যাত্রীদের কী অবস্থা হয়, রেলের কর্তাদের তা কে বোঝাবে? রেলকর্তাদের কাছে অনুরোধ, কাজে বেরোনো সাধারণ মানুষের কথা একটু ভাবুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy