Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

তারকেশ্বরের জলযাত্রীদের একাংশের ‘উপদ্রব’, ট্রেনে বসে মদ্যপানের নালিশ

গাঁজা-সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে ওঠে কামরা। আর থেকে থেকে ‘ভোলেবাবা পার করে গা’ চিৎকার!  সোমবার তারকেশ্বর থেকে ছাড়া ট্রেনগুলিতে ওঠার জো থাকে না। গোটা ট্রেনই কার্যত জলযাত্রীদের দখলে চলে যায়।

মৌতাত: হরিপাল স্টেশনের পাশে বসেই চলেছে মাদক সেবন। ছবি: দীপঙ্কর দে

মৌতাত: হরিপাল স্টেশনের পাশে বসেই চলেছে মাদক সেবন। ছবি: দীপঙ্কর দে

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রকাশ পাল
চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ০৪:৪৫
Share: Save:

ভরা শ্রাবণ। বুক কাঁপছে চন্দননগরের রমেশ চক্রবর্তীর!

বর্ষার জন্য নয়। বাঁকের গুঁতো খাওয়ার ভয়ে। গাঁজার কটূ গন্ধের ভয়ে। কুকথার ভয়ে। ড্রাম-বাঁশি, কাঁসর, ঘুঙুরের জগঝম্প আওয়াজের ভয়ে।

ষাটোর্ধ্ব রমেশবাবু ট্রেনের নিত্যযাত্রী। প্রতিদিন কলকাতায় ব্যবসার কাজে যান। যাতায়াতের পথে গোটা শ্রাবণ মাস তিনি সিঁটিয়ে থাকেন। তাঁর মতো একই হাল হয় আরও বহু নিত্যযাত্রীর। কারণ, তারকেশ্বরের জলযাত্রীদের একাংশের ‘উপদ্রব’!

নিত্যযাত্রীদের এই দুর্ভোগ অবশ্য প্রতি শ্রাবণেই পূর্ব রেলের হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল, বর্ধমান (মেন) এবং তারকেশ্বর শাখার ট্রেনগুলিতে ফিরে আসে। রেল পুলিশ, আরপিএফ বা প্রশাসন দেখেও দেখে না বলে অভিযোগ। বিশেষ করে শনি-রবি এবং সোম— প্রতি সপ্তাহের এই তিন দিন জলযাত্রীদের একাংশের আনন্দের আতিশয্যে দিশাহারা হয়ে পড়েন নিত্যযাত্রীরা। প্রতিবাদ বা আপত্তি জানাতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে জলযাত্রীদের বচসাও প্রায়ই দেখা যায়।

তারকেশ্বর লাইন প্যাসেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক হরদাস চক্রবর্তী মানছেন, ‘‘জলযাত্রীদের একাংশের জন্য সমস্যা তো হয়-ই। শ্রাবণ মাসে রেল অতিরিক্ত কয়েকটি ট্রেন চালালেও নিত্যযাত্রীদের যন্ত্রণা লাঘব হয় না।’’

‘‘প্রতি চৈত্রে উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে মতুয়া মেলাতেও ট্রেনে বহু পুণ্যার্থী আসেন। ট্রেনে প্রবল ভিড় হয়। দাঁড়ানোর জায়গা মেলে না। তাঁরা ডঙ্কা-কাঁসর বাজান। কিন্তু অসভ্যতা দেখা যায় না। যেটা এ দিকে তারকেশ্বরের জলযাত্রীদের একাংশ প্রায় অভ্যাস হয়ে গিয়েছে!’’— ক্ষোভ দু’দিকের ট্রেনে নিত্য যাতায়াত করা ব্যান্ডেলের এক প্রৌঢ়ের।

কেমন সেই ‘অসভ্যতা’?

নিত্যযাত্রীদের অভিজ্ঞতা, বড় বড় বাঁক কামরায় বিপজ্জনক ভাবে তোলা হয়। তা সাজানো থাকে ত্রিশূল, নকল সাপ থেকে শুরু করে নানা জিনিসে। নামানো-ওঠানোর সময়ে যাত্রীদের বাঁকের খোঁচা লাগার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু গেরুয়াধারী জলযাত্রীদের একাংশ সে সবের খেয়াল রাখেন না। প্রতিবাদ করলে কুকথা থেকে মারধর— কিছুই বাদ যায় না। গোটা যাত্রাপথে সারাক্ষণ ড্রাম, কাঁসর, বাঁশি, ঘুঙুরের কান পাতা দায় হয়। গাঁজা-সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে ওঠে কামরা। আর থেকে থেকে ‘ভোলেবাবা পার করে গা’ চিৎকার! সোমবার তারকেশ্বর থেকে ছাড়া ট্রেনগুলিতে ওঠার জো থাকে না। গোটা ট্রেনই কার্যত জলযাত্রীদের দখলে চলে যায়।

গত শনিবারই ট্যাক্সি-স্ট্যান্ড লাগোয়া হাওড়া স্টেশনের প্রবেশপথের থামের আড়ালে দেখা গেল গোলাবাড়ি এলাকা থেকে আসা সাত-আট জন তরুণ জলযাত্রীকে। যাত্রার আগে কলকেতে টান দিতে ব্যস্ত। তাঁদেরই এক জন বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবার যাই। শেওড়াফুলিতে গিয়ে নিমাইতীর্থ ঘাট থেকে জল নিয়ে সোজা বাবার মন্দিরে। তবে, আজ রাতে আনন্দ করব। এ সব তো একটু চলবেই। রবিবার ভোরে জল নিয়ে হাঁটা লাগাব।’’

ব্যান্ডেলের নিত্যযাত্রী উত্তম দত্তের ক্ষোভ, ‘‘এমন ভাবে বাঁক রেখে দেওয়া হয়, বলার নয়। ঠান্ডা পানীয়ের বোতলে মদ ঢেলেও খান কিছু জলযাত্রী। গাঁজাও চলে। ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারি না।’’ উত্তরপাড়ার নীতেশানন্দ ভট্টাচার্যের অভিযোগ, ‘‘রবি-সোমবারের সকালের ডাউন ট্রেনগুলিতে কাদামাখা প্রায় ঘুমন্ত জলযাত্রীরা ফুটবোর্ডটাই দখল করে নেন। ওই কাদা অফিসযাত্রীদের পোশাকেও লাগে। কাকে কী বলব! সবাই নেশায় চুর।’’

কী বলছে পুলিশ প্রশাস ন?

পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্র বলেন, ‘‘তারকেশ্বরের ভিড় সামাল দিতে অতিরিক্ত ট্রেন চালানো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় রেখে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।’’ হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার নীলাদ্রি চক্রবর্তী বলেন, ‘‘হাওড়ার পাশাপাশি শেওড়াফুলি, সিঙ্গুর, কামারকুণ্ডু, তারকেশ্বরের মতো স্টেশনে বাড়তি পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে। মহিলাদের সুরক্ষার জন্য বাড়তি মহিলা পুলিশও থাকছে। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’’

নিত্যযাত্রীদের আতঙ্ক তবু কাটে না।

(সহ প্রতিবেদন: শুভ্র শীল)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pilgrims Tarakeswar Train Alcohol
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE