Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

গোঘাটে চাষির মৃত্যু, ঘনাচ্ছে আশঙ্কার মেঘ

ভিজে আলু তুলে ফেললে যে সমস্যা হতে পারে তা জানেন চাষিরা। এক তৃতীয়াংশ আলুও ঘরে তুলতে পারবেন না বলে মনে করছেন হুগলির চাষিরা। তবু বৃষ্টি আসার আগে যেটুকু তুলে রাখা যায়!

মৃত জগন্নাথ রায়। —ফাইল চিত্র।

মৃত জগন্নাথ রায়। —ফাইল চিত্র।

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
চুঁচুড়া ও গোঘাট শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০১:৪৭
Share: Save:

ফের মেঘ জমেছে আকাশে। আবহাওয়া দফতর সোমবার থেকে বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে। মরিয়া আলু চাষিরা রবিবার থেকে আলু তুলতে শুরু করেছেন। মাঠ যদিও ভিজে। ভিজে আলু তুলে ফেললে যে সমস্যা হতে পারে তা জানেন চাষিরা। এক তৃতীয়াংশ আলুও ঘরে তুলতে পারবেন না বলে মনে করছেন হুগলির চাষিরা। তবু বৃষ্টি আসার আগে যেটুকু তুলে রাখা যায়!

এরই মধ্যে শনিবার গোঘাটে মৃত্যু হয়েছে এক আলু চাষির। গোঘাটের গুরুলিয়া-ভাতাশালা গ্রামের ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, জগন্নাথ রায় (৪৮) নামে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে। কিন্তু তাঁর স্ত্রী নমিতা রায় বলেন, ‘‘আমাদের মাত্র ৫ কাঠা জমি। চুক্তিতে অন্যের ৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলন। প্রায় ১লক্ষ টাকা দেনা। আলু তোলার মাথায় জমিতে জল ঢুকে যায়। সারাদিনই মনমরা হয়ে মাঠে পড়ে থাকছিলেন উনি। শনিবার সকালে মাঠে যাবার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন।’’ ছেলে মঙ্গল জানিয়েছেন, জগন্নাথের সব জমি ছিল খালের ধারে। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি জল বের করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু জল বের করার পথ ছিল না। মঙ্গল বলেন, ‘‘গত দু’বছরে বাবার প্রায় ২ লক্ষ টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। কী ভাবে শোধ হবে— তা ভেবে ভেবেই বাবা শেষ হয়ে গেল।’’

গত শুক্রবার থেকে খুলে গিয়েছে হুগলির ১৪২ হিমঘর। যদিও আলুর লরি সে দিকে প্রায় যায়নি বললেই চলে। সাধারণত ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসে এমন বৃষ্টি হয় না দক্ষিণবঙ্গে। কৃষি দফতরের খবর অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে মোট ৮২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার থেকে ফের বৃষ্টির সম্ভাবনা। রাজ্যের মধ্যে হুগলি, বর্ধমান এবং পশ্চিম মেদিনীপুরে সব থেকে বেশি আলু উৎপাদন হয়। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা ছিল, এ বার অন্তত ১ কোটি ১০ লক্ষ মেট্রিক আলু উঠবে। কিন্তু বৃষ্টি সব হিসাবে নয়ছয় করে দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন হুগলির চাষিরা।

হুগলির চণ্ডীতলা এলাকার একটি হিমঘরের ম্যানেজার সুশীলকুমার খাঁ বলেন, ‘‘পরিস্থিতি যা তাতে আগামী সাতদিন কত আলু হিমঘরে আসবে বা আদৌ আসবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।’’ সুশীলবাবুও জানিয়েছেন, জমি একটু শুকিয়ে না গেলে জমিতে নামতে পারবেন না চাষিরা। ফলে আলু তুলতে দেরি হয়ে যাবে। আবার জলে ভেজা আলুও তো হিমঘরে ঢোকানো যাবে না।

ধনেখালির এক হিমঘর মালিক বলেন, ‘‘ভিজে আলু হিমঘরে ঢোকালে নষ্ট হবেই। তাই ভাল করে রোদ না উঠলে সমস্যা হবে।’’ আলুর মরসুমে বহু শ্রমিক আসেন হুগলিতে রাজ্যের নানা এলাকা মূলত সুন্দরবন থেকে। তাঁদের রোজগারও বন্ধ। জাঙ্গিপাড়া এলাকার একটি হিমঘরের ম্যানেজার বলেন, ‘‘আকাশের পরিস্থিতি দেখেই শ্রমিকদের জানিয়ে দিয়েছি কিছুদিন পরে আসতে।’’

আবার চাষিও এখন শুধু বিমার টাকার উপরই ভরসা রাখতে চাইছেন। হুগলি এবং বর্ধমানের মতো আলু উৎপাদক জেলাতে কমবেশি একই ছবি। কৃষি আধিকারিকেরা আলুতে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারনের পাশাপাশি যে সব চাষিরা বিমার আওতায় আছেন, তাঁদের বিষয়টিও খতিয়ে দেখছেন।

প্রাথমিক ভাবে চাষিরা যে হিসাব কষছিলেন, তাতে তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন অতিরিক্ত উৎপাদনে দাম পাওয়া যাবে না। ভাবা হয়েছিল ১ কোটি ১০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৩০ লক্ষ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হতে পারে। কিন্তু বৃষ্টির পরে এখন চাষিরা হিসাব কষছেন জমি থেকে পচা আলু বাদ দিয়ে ঠিক কতটা আলু তাঁরা ঘরে তুলতে পারবেন!

ধনেখালি কানানদী এলাকার চাষি কাশীনাথ পাত্র এ বার দশ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তিনি রবিবার মাঠে নেমেছিলেন আলু তুলতে। বলেন, ‘‘অনেক খরচ করে ফেলেছি। কিন্তু সারা বছর নিজের খাওয়ার মতো আলুটুকুও তুলতে পারিনি। বৃষ্টি হল, তাতে আলুর গায়ে জলের দাগ ধরে যাবে।’’ গোঘাটে মৃত চাষি জগন্নাথ রায়ের প্রতিবেশীরা বলছেন, ‘‘ও তো মরেই গেল। আমরাও ও ভাবে মরে যেতেও পারব না। কেউ আত্মহত্যা করবে, কেউ সর্বস্বান্ত হবে!’’

এই পরিস্থিতিতে কৃষি দফতরের আধিকারিকেরা অবশ্য জানিয়েছেন, যে সব চাষিরা বিমার আওতায় আছেন, তাঁরা শস্য বিমার টাকা পাবেন। আলুর ক্ষতি নির্ধারণের সময় কৃষি আধিকারিকেরা চাষিদের বিমার বিষয়টিও দেখছেন। যে চাষিরা বিমার আওতায় পড়েছেন, তাঁরা কৃষি সমবায় থেকে যে ঋণ নিয়েছেন তা সরাসরি ব্যাঙ্কে জমা পড়ে যাবে। বিমার টাকাতেই কৃষিঋণ তাঁদের শোধ হয়ে যাবে। যে সব চাষির অবশ্য ঋণ নেই, তাঁরা তাকিয়ে আছেন সরকারি ঋণ মুকুবের দিকে।

তথ্য সহায়তা: পীযূষ নন্দী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

farmer Goghat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE