মজুত: সিঙ্গুরের আড়তে রয়েছে বিষাক্ত রং। ছবি: দীপঙ্কর দে
রাজ্য সরকারের কড়া নির্দেশ— আলুতে রং মেশানো যাবে না। মেলানো যাবে না ইটের গুঁড়োও।
অথচ, সে সব কাজ দিব্যি চলছিল সিঙ্গুরের একাধিক আলুর আড়তে। গত বুধবার সেখান থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে ১৬ জনকে। ধৃতদের মধ্যে ১৫ জন আলু বাছনদার, এক জন আড়তদার। বৃহস্পতিবার তাঁদের চন্দননগর আদালতে তোলা হলে সকলকেই জামিন দিয়েছেন বিচার।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের জানা গিয়েছে, বুধবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ সিঙ্গুর থানার পুলিশ স্থানীয় রতনপুর মোড়ে এক আলুর আড়তে হানা দেয়। জেলা (গ্রামীণ) পুলিশের আধিকারিকরা জানান, সূত্র মারফত খবর পেয়ে ওই অভিযান চালানো হয়। বিভিন্ন আড়ত থেকে ইটের গুঁড়ো, অন্যান্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়। পুলিশই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করেছে।
ঘটনার পর থেকেই সিঙ্গুরে শুরু হয়েছে ক্ষোভ। বাছনদারদের দাবি, তাঁরা টাকার জন্য আড়তদারদরে কথায় কাজ করেন। ১৫ জন বাছনদারকে গ্রেফতার করা অন্যায়। বৃহস্পতিবার কয়েকশো আলু বাছনদার বিক্ষোভ দেখান।
আলু-বাছনদার প্রশান্ত মান্না বলেন, ‘‘৩০ বছর ধরে এই কাজ করছি। আমরা তো দিনমজুর হিসেবে মালিকের কথা শুনে কাজ করি। কথা না শুনলে কাজ পাব না।’’ গ্রেফতার হওয়া আলু-বাছনদার শঙ্কর দাস-সহ অনেকেই একই প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
সিঙ্গুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে লাগোয়া রতনপুর মোড়ে বৈদ্যবাটী-তারকেশ্বর রোডের দু’ধারে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় আড়াশো আলুর আড়ত। রাতে আলু হিমঘর থেকে বের করে আড়তে এনে আলু বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার পরে ইটের গুঁড়ো বা অ্যালামাটি মাখিয়ে পাখা চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলে আলু শুকনোর সঙ্গে সঙ্গেই তাতে ইটের গুঁড়ো বা অ্যালামাটি আটকে যায়।
কী লাভ হয় তাতে?
আলুতে ফাটা বা ফুটো থাকলে ওই গুঁড়োয় তা ঢেকে যায়। ঝকঝকে লাগে। এমনকি পচা আলুরও চেহারা বিলকুল বদলে তরতাজা হয়ে যায়। আড়তদাররা মানছেন, ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্যই এই কাজ করা হয়। না হলে দাম মেলে না।
বাম-ডান সব আমলেই রাজ্য সরকারের তরফে আলুতে রং মেশানোর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বছর দু’য়েক আগে এ ব্যাপারে রাজ্য সরকার কড়া অবস্থান নেওয়ার কথা জানায়। ২০১৬ সালের ২০ জুন থেকে ওই নির্দেশ কার্যকরী করার কথা বলা হয়েছিল। সেই সময়েই হুগলি জেলার আলু ব্যবসায়ী সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছিল, রাজ্য সরকারের নির্দেশ মেনে আলুতে রং মাখানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ব্যবস্থা যথাযথ ভাবে কার্যকর করার চেষ্টা করা হবে। এর পরেও কেউ আলুতে রং মাখালে প্রশাসন যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে। বেশ কিছু দিন আলুতে রং মাখানো বন্ধও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আবার একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
রতনপুর মোড় আলু ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক সুকুমার সামন্তের বক্তব্য, আলুতে রং করা আটকাতে সংগঠনের তরফে জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু তা কার্যকরী করা যায়নি। তাঁর কথায়, ‘‘সর্বত্রই আলু রং করা হয়। নিয়ম মানতে গিয়ে এখানকার ব্যবসায়ীরা মার খাচ্ছিলেন। তাই কিছু জায়গায় হলুদ গুঁড়ো, ময়দা এবং ইটের গুঁড়ো বা অ্যালামাটি মেশানো শুরু হয়েছিল।’’ তাঁর দাবি, শহর কলকাতার কাছে বলেই শুধু তাঁদের উপর কোপ পড়ল। অন্যত্র এমনই চলছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) কামনাশিস সেন বলেন, ‘‘এই ধরণের অভিযান চলবে।’’ কৃষি বিপণনমন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সিঙ্গুরে প্রথম অভিযানে রং মেশানো ১০ বস্তা আলু বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ১৭টি আড়তে ওই কাজ হচ্ছিল। রাজ্যের সর্বত্র এমন অভিযান চলবে, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ।’’
আলুর আড়তের সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই দাবি, ইটের গুঁড়ো শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর না। চিকিৎসকদের অনেকেই অবশ্য অন্য কথা বলছেন। তাঁদের বক্তব্য, আলু কেটে-ধুয়ে রান্না করলেও ইটের গুঁড়ো বা রং পুরোপুরি চলে যায় না। কেননা, আলুর শরীরে তা মিশে যায়। ফলে তা থেকে নানা ধরণের সমস্যা হয়।
হুগলির সহকারী মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক (জনস্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ) প্রকাশ বাগ বলেন, ‘‘পচা অখাদ্য আলু খেলে পেটের অসুখ হতে পারে। পেটে অস্বস্তি, পেটব্যথা এবং পায়খানা ভাব হয়। ইটের গুঁড়োর রেড অক্সাইডের কারণে চর্মরোগ হয়।’’
প্রকাশবাবুর সংযোজন, ‘‘অনেক দিন ধরে ক্ষতিকর জিনিস পেটে গেলে অন্ত্রে ক্যান্সার হতে পারে। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আলুতে জৌলুস আনতে এক ধরণের অ্যানিম্যাল প্রোটিন ব্যবহার করা হয়। এতেও পেটের রোগ হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিস্কে প্রভাব ফেলতে পারে।’’
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ প্রদীপকুমার দাস বলেন, ‘‘ইটের গুঁড়োয় থাকা রেড অক্সাইড থেকে অ্যালার্জি হতে পারে। চুলকানি, জ্বলুনি বা র্যাশ বেরোতে পারে। বহু দিন ধরে চামরার সংস্পর্শে এলে ত্বকের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy