এমন ছবি ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে। ছবি: দীপঙ্কর দে।
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে তাঁদের বেশির ভাগেরই অখণ্ড অবসর।
সকাল-বিকেল আড্ডা মেরে যে একঘেঁয়েমি কাটাবেন, সে সুযোগই বা শহরে কোথায়!
গঙ্গার ধারে হাতেগোনা কিছু পার্ক রয়েছে। কিন্তু ছেলেছোকরার দল সেই সব পার্ক দখল করে রাখে। আর রয়েছে শহরের ভিতরের কিছু পার্ক। কিন্তু সেখানেও যে একই অবস্থা!
তাই বাধ্য হয়েই শ্রীরামপুরের প্রবীণ বাসিন্দাদের অনেকেই আড্ডার ঠিকানা হিসেবে বেছে নেন রেল স্টেশন। অথচ, স্টেশনে যাতায়াতে প্রতিদিন যানজটের বিস্তর ঝক্কি সামলাতে হয় যে! স্টেশন যাওয়ার রাস্তায় ফুটপাথ বেদখল। রাস্তা জুড়ে রিকশা, টোটো বা অন্য গাড়ি প্রায় গায়ের উপর উঠে আসে। ঘিঞ্জি রাস্তায় পা ফেলার জায়গা থাকে না। সন্তর্পণে চলেও ধাক্কা লাগার উপক্রম হয় প্রতি মুহূর্তে। তাই শহরের প্রবীণ বাসিন্দাদের অনেকেরই এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। তাঁরা চান, অন্তত একটা পার্কের ব্যবস্থা হোক শুধুমাত্র বয়স্কদের জন্য। না হলে নিদেনপক্ষে পার্কগুলিতে নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ রাখা হোক তাঁদের জন্য। তা-ও সম্ভব না হলে গড়া হোক কমিউনিটি হল।
শহরের দে স্ট্রিট এলাকায় থাকেন অবসরপ্রাপ্ত রেলকর্মী প্রশান্তকুমার মুখোপাধ্যায়। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘বিকেলে আমাদের বয়সী অনেকেই গঙ্গার দে ঘাটে গিয়ে বসি। কিন্তু সেখানে মাথার উপরে কোনও ছাউনি নেই। বৃষ্টি হলে মুশকিলে পড়তে হয়। পুরসভা এ ব্যাপারটায় নজর দিলে ভাল হয়। আজকাল পার্ক বা বসার জায়গাগুলো কমবয়সী ছেলেমেয়েরা দখল করে নেয়। ওদের কথাবার্তার মাঝে বসে থাকা কখনও কখনও অসম্মানজনক মনে হয়। পার্কের একটা দিক বয়স্কদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।’’
লোকনাথ মুখোপাধ্যায় নামে এক প্রবীণের কথায়, ‘‘শহরে বয়স্কদের আড্ডা মারার জায়গা সীমিত। সেই কারণে স্টেশনে যেতে হয়। আমাদের মতো মানুষদের আড্ডা মারার জায়গা বাড়ানো দরকার। তা হলে শহরে ছোট পরিসরে সাংস্কৃতিক চর্চাও বাড়বে।’’ বড়বাগান এলাকার বাসিন্দা দিলীপ ভট্টাচার্যও মনে করেন, চেনা শহরটা যে ভাবে ক্রমশ ঘিঞ্জি হয়ে পড়ছে, তাতে বয়স্কদের নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা কমছে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।
বিকেলে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে বসেন কালীপ্রসাদ ঘোষাল, রমাপ্রসাদ সরকাররা। গল্পগুজব হয়। মনটা ফুরফুরে হয়। জিতেন্দ্রনাথ লাহি়ড়ী রোডের প্রবীণ বাসিন্দা হারাধন রক্ষিত সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি বলেন, ‘‘বয়স্কদের জন্য আলাদা করে কেউ ভাবেন না। শুধুমাত্র বয়স্কদের জন্য কমিউনিটি হল হলে খুবই ভাল হয়। সেখানে সময় কাটানো যায়। অসুখ-বিসুখ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। পারিবারিক সমস্যা নিয়েও কথা বলা যেতে পারে। এ ব্যাপারে পুর-কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।’’
গত কয়েক বছরে কলেজ ঘাট, রায়ঘাট-সহ শহরের গঙ্গার ধারের কয়েকটি জায়গায় সৌন্দর্যায়ন করা হয়েছে। তবে, বয়স্কদের জন্য আলাদা কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায়ের নিজেও প্রবীণদের দলে। তাঁর বয়স প্রায় সত্তর। তিনি বলেন, ‘‘বয়স্ক লোকজনের বিষয়টা বুঝি। তাঁদের সময় কাটানোর পরিধি বাড়নো প্রয়োজন। সেই চেষ্টা করাও হচ্ছে। তবে বয়স্কদের জন্য আলাদা ভাবে কিছু করা নিয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাব পেলে নিশ্চয়ই ভাবনাচিন্তা করা হবে।’’
এক সময় এ তল্লাটে বয়স্কদের ‘সাঁকো-কালচার’ ছিল। পাড়ার মোড়ে মোড়ে সাঁকো অথবা বাঁশের মাচায় লাঠি হাতে বসে বয়স্করা আড্ডা দিতেন। হাসি-মস্করা হত। চেনা সেই শহরের মুকুটে এখন আধুনিকতার নানা উপকরণ শপিং মল, নামী রেস্তোরাঁর পালক। কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য তেমন বাড়েনি। নয়া প্রজন্ম এখন ফ্ল্যাট-কালচারে অভ্যস্ত। ফলে, পুরনো দিনের সেই স্মৃতিই রোমন্থন করে চলেন প্রবীণেরা। কেউ কেউ অবশ্য স্টেশনে চলে যান সময় কাটাতে।
এ ছাড়াও শহরে রাস্তার ধারে শৌচাগারের সংখ্যা বাড়ানো, নেতাজি সুভাষ অ্যাভিনিউ বা রাজেন্দ্রবাগ রোডের ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, রাস্তা জুড়ে রিকশা-টোটোর দাপাদাপি বন্ধ করার মতো দাবিও রয়েছে প্রবীণদের।
অন্যান্য দাবির বিষয়ে না বললেও শহরে যানজটের সমস্যা মেটাতে পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে শীঘ্রই বৈঠকের আশ্বাস দিয়েছেন পুরপ্রধান।
দশকের পর দশক আশ্বাসই সার। এই আশ্বাসও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে কি না, অপেক্ষায় প্রবীণেরা।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy