ব্যক্তিগত গাড়িও খাটছে পুলকারে।—নিজস্ব চিত্র।
চিত্র ১। বাগনানের মানকুর মোড়। সময় সকাল সাড়ে সাতটা। বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সামনে দাঁড়াল পুলকার। নামেই পুলকার, আদলে একটা ছোট গাড়ি। গাঁ-গঞ্জে পরিচিতি ম্যাজিক গাড়ি নামে। গাড়ি না বলে খাঁচা বলাই ভাল। কারণ, গাড়ি থামলে যে ভাবে এবং যতজন পড়ুয়া নেমে দুদ্দাড় করে স্কুলে ঢুকে গেল তাতে মনে হল যেন হাঁপ ছাড়ল ওরা। লোহার রডের জানালা। ভিতরে তিন সারি বেঞ্চি। তাতেই কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসেছিল। গুনে দেখা গেল ২২ জন ছাত্রছাত্রী নামল গাড়ি থেকে।
চিত্র ২। উলুবেড়িয়ার বাণীবন গার্লস হাইস্কুল। সকাল সাড়ে ১০টা। সরকারি এই স্কুলের সামনে যে পুলকার এসে থামল তা আদলে অটোরিকশা। সাধারণভাবে চারজনের বেশি যাত্রীর অনুমতি না থাকলেও পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণির বিভিন্ন বয়সের অন্তত ২০ জন ছাত্রী নামল অটো থেকে। বোঝা গেল অনেকেই এ ওর কোলে চেপে এসেছে।
বেসরকারি স্কুল হোক বা সরকারি স্কুল— সব ক্ষেত্রেই পড়ুয়াদের স্কুলে আনতে এমনই সব পুলকারের রমরমা হাওড়া জেলা জুড়ে। অবশ্য ছোট মারুতি ভ্যানও রয়েছে। যদিও তার বেশিরভাগেরই পুলকার হিসাবে বৈধতা নেই। নিত্য এ সব গাড়িতেই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে যাতায়াত করেন পুলকার চালকেরা। দুর্ঘটনাও ঘটে। যেমন ঘটেছে সোমবার কুলগাছিয়ায়। পড়ুয়াদের নিয়ে স্কুলে আসার পথে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুলকারটি একটি ম্যাটাডরের পিছনে ধাক্কা মারায় গুরুতর জখম হন চালক-সহ আটজন পড়ুয়া। দেখা গিয়েছে, ওই গাড়িতে চালক-সহ থাকার কথা আটজনের। কিন্তু ছিল মোট ১৭ জন ছাত্রছাত্রী।
অটোরিকশাও পুলকার।
সম্প্রতি কলকাতায় পর পর পুলকার দুর্ঘটনা এবং সোমবার কুলগাছিয়ার ঘটনায় জেলায় পুলকারগুলির বিষয়ে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। প্রশাসনের একাংশ সূত্রে খবর, শহরে তবু কিছু বিধিনিষেধ মানার তাগিদ থাকলেও জেলায় যে সব পুলকার চলে সেগুলির প্রায় সবই বেআইনি। অথচ বহু স্কুলেই এদিকে কোনও নজর দেওয়া হয় না। অভিভাবকেরাও বিষয়টি নিয়ে উদাসীন। বেসরকারি-সরকারি সব স্কুলেই এক ছবি।
কী বলছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ?
বাগনানের বেসরকারি স্কুলটির অধ্যক্ষ শেখ মেহবুব আলি বলেন, ‘‘যাতায়াতের যে খরচ অভিভাবকেরা দেন তাতে পোষায় না। ফলে নিরুপায় হয়েই কিছু বেশি ছাত্রছাত্রী গাড়িতে তুলতে হয়।’’ একইসঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘চালকদের বলা আছে তাঁরা যেন ছাত্র-ছাত্রীদের সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দেন। সাবধানে গাড়ি চালান।’’ তিনি জানান, স্কুলে মোট আটটি গাড়ি চলে। স্কুল সূত্রের খবর, তার মধ্যে ছ’টি গাড়ির বাণিজ্যিক লাইসেন্স থাকলেও দু’টি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করা হয়।
অটোয় ছাত্রী আসার খবরে আকাশ থেকে পড়লেন এক সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি জানান, ম্যাজিক এবং মারুতি ভ্যান মিলিয়ে স্কুলের তিনটি গাড়ি চলে। সবার কাগজপত্র দেখে নেওয়া হয়। কোনও অটো চলে না।’’ অটোর প্রশ্নের তাঁর উত্তর, ‘‘অভিভাবকেরাই হয়তো সেগুলি নিজেদের উদ্যোগে ভাড়া করে থাকবেন।’’ অভিভাবকদের অনেকেই জানান, নিরুপায় হয়েই তাঁদের এ ভাবে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাতে হয়। কারণ জেলার বহু জায়গাতেই ঠিকমতো পরিবহণ মেলে না। তবে সরকারি নজরদারি থাকলে যে বেআইনি পুলকারের রমরমা কমবে তা জানান তাঁরা।
বেআইনি পুলকার নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে হাওড়ার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক পার্থপ্রতিম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা একটা আর্থ সামাজিক সমস্যা। স্কুলগুলির যেমন পরিকাঠামোগত সমস্যা আছে, অভিভাবকদেরও অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে। দুম করে রাতারাতি এ সব বন্ধ করলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।’’
তবে সোমবারের ঘটনার পর তাঁর বক্তব্য, ‘‘পুলকারগুলির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদের বোঝানো হবে যাতে বেআইনি গাড়ি ব্যবহার না করেন।’’ পুলকার সমস্যা মেটাতে বিভিন্ন স্কুল কর্তৃপক্ষকে নিয়ে শীঘ্রই বৈঠকে বসবেন বলে জানিয়েছে উলবেড়িয়ার মহকুমাশাসক অংশুল গুপ্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy