Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

এগিয়ে আসেনি কেউ, তিন ঘণ্টা পথে পড়ে মৃত্যু বৃদ্ধের

তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। শেষমেশ বিনা চিকিৎসায়, সকলের চোখের সামনেই মারা গেলেন অজ্ঞাতপরিচয় ওই বৃদ্ধ।

অমানবিক: ফুটপাথে পড়ে বৃদ্ধ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

অমানবিক: ফুটপাথে পড়ে বৃদ্ধ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

দেবাশিস দাস
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৭ ০১:৫৮
Share: Save:

দুপুরের ঠা ঠা রোদে বঙ্কিম সেতুর রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। দীর্ঘক্ষণ, একই ভাবে। চোখ বোজা। ঘাড় সামান্য হেলে রয়েছে।

ওই ফুটপাথ দিয়েই যাতায়াত করেছেন অজস্র মানুষ। সকলেই তাঁকে দেখেছেন। কেউ কেউ থমকে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়েছেন। পাশের জনকে হয়তো কিছু বলেওছেন।
কিন্তু ওই পর্যন্তই! বৃদ্ধকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি কেউই। এমনকী ওই বৃদ্ধ যে ব্যস্ত রাস্তায় ওই ভাবে পড়ে রয়েছেন, সেই খবর পৌঁছয়নি পুলিশের কানেও! তাই এগিয়ে আসেনি পুলিশের টহলদার গাড়ি বা হাওড়া সিটি পুলিশের ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্সও। পুলিশ যতক্ষণে খবর পেল, ততক্ষণে
তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। শেষমেশ বিনা চিকিৎসায়, সকলের চোখের সামনেই মারা গেলেন অজ্ঞাতপরিচয় ওই বৃদ্ধ।

ঠিক যেন ন’বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সে বার বাসের পিছনে ছুটে অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে রাস্তায় বসে মৃত্যু হয়েছিল কমলপ্রসাদ পন্থ নামে নেপালের এক বাসিন্দার। সে দিনও তাঁকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেননি। পুলিশ এসেছিল তিন ঘণ্টা পরে।

আরও পড়ুন: রোগ ১২ লাখি, ঘণ্টেশ্বরের জীবনে এল আলো

কী ঘটেছিল সোমবার? পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ তীব্র গরমে সবাই যখন হাঁসফাঁস করছে, তখন হাওড়া ব্রিজের দিক থেকে হেঁটে বঙ্কিম সেতুর দিকে আসছিলেন ওই বৃদ্ধ। মাথায় কাঁচা-পাকা কোঁকড়ানো চুল। গালে কয়েক দিনের না-কামানো দাড়ি। গায়ে কালো স্ট্রাইপ দেওয়া জামা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হাওড়া ব্রিজ থেকে যে রাস্তাটি বঙ্কিম সেতুতে উঠে বাঁ দিকে ঘুরেছে, সেখানেই সেতুর রেলিংয়ে হেলান দিয়ে প্রথমে বসে পড়েন তিনি। ঘণ্টা দুয়েক ও ভাবে বসে থাকার পরে শুয়ে পড়েন ফুটপাথেই। তাঁর আশপাশ দিয়ে তখন যাতায়াত করছেন নিত্যযাত্রীরা। কেউ কেউ ভেবেছেন, গরম সাময়িক অসুস্থতার কারণে বৃদ্ধ ওই ভাবে শুয়ে আছেন। তাঁরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু কেউ বৃদ্ধের মুখে সামান্য জলটুকুও তুলে দেননি। খানিকক্ষণ থমকে দেখে আবার হেঁটে চলে গিয়েছেন।

চিকিৎসকের পরীক্ষার আগেই ‘মৃতদেহ’ হিসেবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাঁকে।

ওই ফুটপাথেই ডালা নিয়ে পেয়ারা বিক্রি করতে বসেছিলেন সাবিরুদ্দিন মোল্লা। তিনি বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধ যে অসুস্থ বুঝতে পারছিলাম। ওঁর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলার মতো বেরোচ্ছিল। আমার গামছা দিয়ে মুখ মুছিয়ে গামছাটা কোমরে জড়িয়ে দিয়ে এসেছিলাম। আমি গরিব মানুষ বাবু, আর কী করতে পারি?’’ সাবিরুদ্দিনের আফশোস, তখন বহু মানুষ ওই বৃদ্ধের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়েছেন। তাঁর কাছে যাঁরা পেয়ারা কিনতে এসেছিলেন, তাঁদেরও কয়েক জনকে তিনি সাহায্য করতে বলেছিলেন। কিন্তু কেউই কিছু করেননি।

ওই ফল বিক্রেতা জানান, প্রায় দু’ঘণ্টা বসে থাকার পর ফুটপাথে শুয়ে পড়েন ওই বৃদ্ধ। তারও প্রায় আধ ঘণ্টা পরে গোলাবাড়ি থানার একটি টহলদারি ভ্যান আসে। অভিযোগ, ওই ভ্যানের পুলিশকর্মীরাই জানিয়ে দেন, ওই বৃদ্ধ মারা গিয়েছেন। তাই ডাক্তার না ডেকে গোড়াতেই খবর দেওয়া হয় থানার ডোমকে। দুপুর আড়াইটে নাগাদ ডোম পৌঁছলে একটি টোটো করে বৃদ্ধকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাঁকে সরকারি ভাবে ‘মৃত’ ঘোষণা করেন।

এই ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে গত বছরই ছ’টি অত্যাধুনিক ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স পেয়েছিল
হাওড়া সিটি পুলিশ। উদ্দেশ্য ছিল, পথে-ঘাটে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়া মানুষকে সাহায্য করা এবং দুর্ঘটনায় জখমদের যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে দেওয়া। এ দিনের ঘটনার পরে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, ট্রমা অ্যাম্বুল্যান্সের কার্যকারিতা কি তা হলে খাতায়-কলমেই সীমাবদ্ধ? ওই বৃদ্ধ ও ভাবে পড়ে থাকলেও কেন পুলিশের ট্রমা কেয়ার অ্যাম্বুল্যান্স তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেল না? কেনই বা তিন ঘণ্টা পরে পুলিশ জানতে পারল, এক বৃদ্ধ সেতুর উপরে অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন?

হাওড়া সিটি পুলিশের এক কর্তা সাফাই দিয়েছেন, ‘‘শহরের ছ’টি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে থাকে। আসলে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বুঝতে পেরেছিল আগেই ওই বৃদ্ধ মারা গিয়েছেন। তাই আর অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা হয়নি।’’

হাওড়া সিটি পুলিশের ডিসি (সদর) দেবব্রত দাস বলেন, ‘‘এমনটা কখনওই হওয়ার কথা নয়। যাঁরা এই কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলা হবে। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE