Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ফেরিঘাটে হুইল চেয়ার, নো-স্মোকিং জোন

জেটি দিয়ে অতটা হেঁটে ভুটভুটি ধরতে হবে? ভেবেই চিন্তায় পড়েছিলেন বৃদ্ধা। ঘাটের কর্মীদের জানাতেই মুশকিল আসান। হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাঁকে ভুটভুটি পর্যন্ত দিয়ে আসা হল। শুধু হুইল চেয়ারই নয়, যাত্রী স্বাচ্ছ্বন্দ্যের কথা মাথায় রেখে কোন্নগর-পানিহাটি ফেরিঘাটে আমূল পরিবর্তন হয়েছে বছর দেড়েক ধরে।

ফেরিঘাটে হুইল চেয়ারে যাত্রী। ছবি: প্রকাশ পাল।

ফেরিঘাটে হুইল চেয়ারে যাত্রী। ছবি: প্রকাশ পাল।

প্রকাশ পাল
কোন্নগর শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৬ ০৮:০৫
Share: Save:

জেটি দিয়ে অতটা হেঁটে ভুটভুটি ধরতে হবে? ভেবেই চিন্তায় পড়েছিলেন বৃদ্ধা। ঘাটের কর্মীদের জানাতেই মুশকিল আসান। হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাঁকে ভুটভুটি পর্যন্ত দিয়ে আসা হল।

শুধু হুইল চেয়ারই নয়, যাত্রী স্বাচ্ছ্বন্দ্যের কথা মাথায় রেখে কোন্নগর-পানিহাটি ফেরিঘাটে আমূল পরিবর্তন হয়েছে বছর দেড়েক ধরে। এখন কর্মীরাই ঘাট চালাচ্ছেন‌। নয়া পরিষেবায় সন্তুষ্ট যাত্রীরা। ভুটভুটিতে চাপার আগে প্রয়োজনে ঘাট থেকেই পানীয় জল ভরে নিতে পারছেন তাঁরা। রয়েছে সুলভ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থা।

অথচ পরিস্থিতি এমনটা ছিল না। হুগলির কোন্নগর থেকে উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটি পর্যন্ত ফেরি চলাচল নিয়ে জটিলতা আর অভিযোগের অন্ত ছিল না। নিজেদের মধ্যে গোলমালে ব্যহত হচ্ছিল পরিষেবা। আর তার ফল ভুগতে হচ্ছিল সাধারণ যাত্রীদের।

বাসিন্দারা জানালেন, কোন্নগর-পানিহাটির মধ্যে ফেরি চলাচল প্রায় ৪ দশক পুরনো। তখন বাঁশের জেটি ছিল। পারাপার চলত দাঁড় টানা নৌকোয়। পরে ভুটভুটি আসে। ২০০০ সালে সুভাষ চক্রবর্তী রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী থাকাকালীন পাকা জেটি তৈরি হয়। তখন পুরসভাই ঘাট চালাত। পরে এক ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু ঘাট পরিচালনা নিয়ে সমস্যা লেগেই ছিল। বছর কয়েক আগে সমবায়ের মাধ্যমে ঘাট পরিচালনা করা আরম্ভ হয়। কিন্তু তাতেও সমস্য বেড়েছে বই কমেনি।

গত কয়েক বছর ধরেই কর্মীদের একাংশ অভিযোগ তুলছিলেন, ঠিকমতো বেতন মিলছে না। পর্যাপ্ত পরিমাণ ভুটভুটি নেই। শেষ পর্যন্ত কর্মীদের একাংশের সঙ্গে সমবায়ের সদস্যদের বিরোধ তৈরি হয়। শেষে কর্মীরা মিলে ঘাট চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। বছর দেড়েক ধরে তাঁরাই কমিটি তৈরি করে ঘাট চালাচ্ছেন। সমবায়ের তরফে অভিযোগ তো‌লা হয়, পুরসভা অনৈতিক ভাবে ঘাট পরিচালনার কাজে হস্তক্ষেপ করছে। পুরসভার মদতে কর্মীদের একাংশ ঘাট দখল করে নিয়েছেন। এই নিয়ে হাইকোর্টে মামলা পর্যন্ত হয়। মামলা এখনও চলছে।

কর্মীরা ঘাট চালানোর দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর থেকে যাত্রী পরিষেবা ঢেলে সাজার দিকে নজর দেওয়া হয়। কোন্নগর ও পানিহাটি পুরসভার দুই চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন ঘাটকর্মীরা। দু’পাড়েই টিকিট কাউন্টার থেকে ঘাট পর্যন্ত ‘নো স্মোকিং জোন’ বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পুরসভার তরফে পানীয় জল, সুলভ শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হয়। গোটা ফেরিঘাট নীল-সাদা রং করা হয়। ঘাটে নিরাপত্তার জন্য মাস তিনেক আগে ‘ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা’ লাগানো হয়েছে। বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী যাত্রীদের সুবিধার্থে দু’পাড়েই একটি করে হুইল চেয়ার রাখা হয়েছে। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। মাঝে মধ্যে যাত্রী সচেতনতার বার্তা দেওয়া হচ্ছে। আবার অডিও-বিজ্ঞাপনও চলছে।

শুধু কী তাই? পানিহাটিতে ফেরিঘাটের দেওয়ালে চৈতন্যদেবের নানা কাহিনীর ছবি আঁকানো হয়েছে। কোন্নগরেও কোনও মনিষীর স্মৃতিতে দেওয়ালে ছবি আঁকানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে কর্মীরা জানালেন। ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের তরফে কোন্নগর পুরসভাকে একটি লঞ্চ দেওয়া হয়েছে। পুর-কর্তৃপক্ষ জানান, আরও একটি জেটি এবং লঞ্চের জন্য রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে।

মাঝিদের ইনচার্জ তরুণ রায় জানালেন, দু’পাড় মিলিয়ে ৫৮ জন কর্মীই এখন ঘাট পরিচালনা করছেন। তরুণবাবুর কথায়, ‘‘আগে নিয়মিত বেতন মিলছিল না। এখন মাসের এক তারিখেই সবার মাইনে হচ্ছে। অন্যান্য সুবিধার টাকাও সময়ে জমা পড়ছে। আর ঘাটের পরিকাঠামোও আগের থেকে বহুগুনে ভাল হয়েছে। এতে যাত্রীরাও খুশি।’’ যাত্রীরা ভুটভুটিতে ওঠানামা করার সময়, দুর্ঘটনা এড়াতে তাঁরা নজর রাখেন বলেও কর্মীদের দাবি।

কোন্নগরের পুরপ্রধান, তৃণমূলের বাপ্পাদিত্য চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘যে সমবায় সমিতি ঘাট পরিচালনা করছিল, তারা পুরসভাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেছিল। কর্মীরা নিয়মিত মাইনে পাচ্ছিলেন না। প্রভিডেন্ট ফান্ড, ইএসআইয়ের টাকা নিয়েও সমস্যা ছিল। অরাজকতা চলছিল। তাই, কর্মীরা মিলে ঘাট চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। এখন কর্মীদের সমস্যা মিটে গিয়েছে।’’ তিনি জানান, যাত্রী স্বাচ্ছ্বন্দ্যের জন্য পানীয় জ‌ল বা শৌচাগার পুরসভার তরফে করে দেওয়া হয়েছে। পুরসভার তরফে ঘাট দেখভালের দায়িত্বে আছেন ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুমিত্রা বগি। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের লক্ষ্য কোন্নগর-পানিহাটিকে পরিষেবার নিরিখে দুর্দান্ত জায়গায় পৌঁছে দেওয়া।’’

মাঝেমধ্যেই এই ঘাট পার হন সৌতির চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘এই ফেরিঘাটে ডামাডোল লেগেই থাকত। নিজেদের মধ্যে গোলমালে কিছুদিন ফেরি চলাচল বন্ধও ছিল। ঘুরপথে যেতে হচ্ছিল। এখন কিন্তু কোনও সমস্যাই নেই। যাত্রী পরিষেবার পাশাপাশি পানিহাটে স্থানীয় ধর্মীয় ইতিহাস দেওয়ালে চিত্রিত করা হয়েছে। এটা প্রশংসনীয়।’’ একই মত পোষণ করলেন আরও অনেক যাত্রী।

সমবায়ের অন্যতম কর্তা তথা পুরসভার সিপিএম কাউন্সিলর তরুণ গাইনের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘আগে ঘাট পরিচালনায় অনেক সমস্যা ছিল। আমরা ঘাট চালানো ২০১২ সালে ভূতল পরিবহণ নিগমের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য চুক্তি করি। পরিষেবা ঢেলে সাজার চেষ্টা করছিলাম আমরা। এ জন্য নিজেদের পকেটের টাকাও ঢেলেছি। কিন্তু কৌশল করে দু’বছরের মধ্যেই আমাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। তাই আমরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Wheel Chair No smoking Zone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE