কচিকাঁচাদের মাঝে সুমিত সাহা। নিজস্ব চিত্র
প্রত্যন্ত গ্রামের পড়ুয়াদের কাছে তিনিই আশার আলো। বছর ছিয়াত্তরের সুমিত সাহার উদ্যোগেই পাঁচ বছর ধরে ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনি ব্লকের ধড়সা অঞ্চলের কুকড়াখুপিতে চলছে একটি অবৈতনিক কোচিং সেন্টার।
বৃহস্পতিবার সেই কোচিং সেন্টারের পাঁচ বছর পূর্তিতে পড়ুয়া ও অভিভাবকদের নিয়ে মিলন অনুষ্ঠান হয়ে গেল। চার-পাঁচজন পড়ুয়া নিয়ে যে প্রতিষ্ঠান পথচলা শুরু করেছিল, তার ছাত্র সংখ্যা এখন তিনশোর কাছাকাছি। ওই সেন্টারে স্থানীয় কুকড়াখুপি, আস্তাপাড়া, লাদনবনি, দোমোহানি, গোপালপুর, ঝপলা, ইন্দ্রপাহাড়ির মতো ২০-২২ টি গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়ারা বিনা খরচে গৃহশিক্ষকদের কাছে পড়াশোনার সুযোগ পায়। সরকারি সাহায্য বলতে কিছুই নেই। সুমিতের ব্যবসার টাকাতেই বছরভর চলে এই প্রতিষ্ঠান।
সল্টলেকের বাসিন্দা সুমিত ২০০৬ সালে তৈরি করেন ‘পশ্চিম মেদিনীপুর লোকহিত সমাজ’। ওই সংগঠনের মাধ্যমে গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় নানা ধরনের সমাজসেবা মূলক কাজ হচ্ছে। সুমিত জানান, জঙ্গলমহলের কাজ করার সুবাদে তিনি লক্ষ করেছেন, দরিদ্র পরিবারের বেশিরভাগ পড়ুয়ার গৃহশিক্ষকের সাহায্য নেওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। বেশিরভাগ প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হওয়ায় খুবই সমস্যা হয়। এই কারণে একাংশ পড়ুয়ার মধ্যে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। ২০১৪ সালে সংগঠনের উদ্যোগে জামবনির ধড়সা পঞ্চায়েতের কুকড়াখুপিতে একটি অবৈতনিক কোচিং সেন্টার চালু করেন সুমিত।
স্থানীয় শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে এবং উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘরে ও বারন্দায় ওই কোচিং সেন্টার চলে। শিশুশিক্ষাকেন্দ্র ও উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাজকর্ম শুরু হওয়ার আগে সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের পড়ানো হয়। বিকেলে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের কোচিং দেওয়া হয়। এলাকার দশজন শিক্ষিক বেকার যুবক-যুবতী কোচিং সেন্টারে পড়ান। শিক্ষকরা সকলেই স্নাতক। তিন জন স্নাতকোত্তর। সংগঠনের তরফে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাধ্যমতো সাম্মানিক দেওয়া হয়। সুমিত বলেন, ‘‘স্কুলছুট ঠেকাতে নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছি আমরা। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার মর্ম বুঝছে। অভিভাবকরাও সচেতন হচ্ছেন। এটাই সদর্থক দিক।’’ ঝপলা গ্রামের জয়শ্রী গিরি কোচিং সেন্টারের সাহায্য নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে এখন শিলদা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন।’’ জয়শ্রী বলেন, ‘‘সুমিত-স্যর পড়াশোনার পাশাপাশি, আমাদের ভাল মানুষ হওয়ার উপদেশ দেন। গাছ লাগাতে বলেন। এলাকা পরিষ্কার রাখার জন্য হাত লাগান।’’ অভিভাবক বরেন মাণ্ডি, সুমি মুর্মু বলেন, ‘‘এলাকার বেশিরভাগ মানুষ প্রান্তিক চাষি অথবা দিনমজুর। অভাবের সংসারে গৃহশিক্ষক রাখা সম্ভব হয় না। সুমিত-স্যরের কোচিং সেন্টারটি এলাকার পড়ুয়াদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তুলছে।’’ সুমিতবাবুর কথায়, ‘‘সবাই যে ভাল ফল করে সেটা নয়। তবে স্কুলের পাট চুকিয়ে পড়ুয়ারা কলেজে যাচ্ছে, উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে? এটাই আমার পরম প্রাপ্তি।’’ ধড়সা পঞ্চায়েতের প্রধান রিতা পাত্রও মানছেন, ‘‘দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের স্বার্থে সুমিত স্যর খুবই ভাল কাজ করছেন। দরিদ্র এলাকায় সুমিত স্যরের এই উদ্যোগে বহু পড়ুয়া স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এখন কলেজেও যাচ্ছে।’’
এ দিনের অনুষ্ঠানে মঞ্চ বেঁধে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে পড়ুয়ারা। পড়ুয়া, অভিভাবক ও গ্রামবাসীদের জন্য দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও ছিল। সুমিতবাবু বলেন, ‘‘জানি না আমার পরে কে এই কোচিং সেন্টার চালাবে। সঙ্গে তো কাউকেই এখনও পর্যন্ত পাচ্ছি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy