রজনীকান্ত দোলই।
বয়স হচ্ছে, মানতে চাইতেন না। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে নিজের বাড়িতে বসে কথার ফাঁকে বলেওছিলেন, ‘আমাকে দেখে কি বৃদ্ধ মনে হয়!’
৭৮ বছর বয়সে ইনিংস থামল মনেপ্রাণে সেই চিরযুবা রজনীকান্ত দোলইয়ের। রবিবার সকালে প্রয়াত হয়েছেন কেশপুরের চার বারের প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক রজনীকান্তবাবু। বাড়িতেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। সঙ্গে সঙ্গে মেদিনীপুরের এক বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। তবে বাঁচানো যায়নি।
দিন তিনেক আগে বাড়িতে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরিজনেরা চিকিত্সকের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেনও রজনীকান্তবাবু রাজি হননি। চেনা ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘কিছু হয়নি। একদম ঠিক আছি।’ তাও পরিজনেরা কলকাতার নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। আজ, সোমবার কলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল। সে সুযোগ অবশ্য পাওয়া গেল না। রজনীকান্তবাবুর ছেলে সত্যব্রত দোলই বলছিলেন, “বাবা নিজেকে একেবারে সুস্থ মনে করতেন।’’
মেদিনীপুর শহরের নজরগঞ্জের বাড়িতে শেষ শ্রদ্ধা। রবিবার।
অবিভক্ত মেদিনীপুরের বর্ষীয়ান এই নেতার সঙ্গে কেশপুরের সম্পর্ক বহুদিনের। একটা সময় কেশপুরে ভোট মানেই ছিল রজনীকান্ত দোলই। হেন ভোট ছিল না, রজনীকান্তবাবু কেশপুর থেকে লড়েননি। প্রথম ভোটে দাঁড়ানো ১৯৬৭ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৭। কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে প্রথম লড়াইয়েই জয়ী হন। ’৬৯-এ অবশ্য হারতে হয়েছিল। ফের জয় আসে ’৭১ ও ’৭২-এ। বামফ্রন্ট যে বার ক্ষমতায় আসে, সেই ১৯৭৭ সালেও বড় ব্যবধানে জিতেছিলেন রজনীকান্তবাবু। সেই কেশপুর থেকেই।
১৯৮২ সালের ভোটে অবশ্য হেরে যান তিনি। সে বার কেশপুরে বাম প্রার্থীর প্রচারে এসেছিলেন খোদ জ্যোতি বসু। তবে হারলেও ভোটে দাঁড়ানো ছাড়েননি রজনীকান্তবাবু। ১৯৬৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে হাতে গোনা দু’-একটি বাদে প্রায় সব বিধানসভা ভোটেই কেশপুর থেকে লড়েছিলেন— কখনও কংগ্রেসের হয়ে, কখনও তৃণমূলের টিকিটে। ১৯৯৮ সালের পরে রাজনৈতিক সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয় কেশপুর। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে নাম লেখান রজনীকান্তবাবু। ২০০১ সালে তৃণমূলের প্রার্থী হন। সিপিএমের নন্দরানি ডলের কাছে অবশ্য বিশাল ব্যবধানে হারতে হয় তাঁকে। পরে তৃণমূল ছেড়ে ফের কংগ্রেস ফিরে আসেন। ২০১১ সালের ভোটেও কংগ্রেসের হয়েই কেশপুর থেকে লড়েছিলেন। শেষ সেই লড়াইয়েও অবশ্য হার মানতে হয়েছিল তাঁকে।
১৯৫৬ সালে কলেজে পড়াকালীন রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ক্রমে ভোটের ময়দানে নামা। গত বিধানসভা ভোটের আগে রজনীকান্তবাবু বলেছিলেন, ‘‘১৯৬৭ সালের ভোটে জিতে যখন বিধায়ক হলাম, তখন আমি ২৭। রাজ্যের নবীন বিধায়ক।’’ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘তখন হুটহাট করে প্রার্থী হওয়া যেত না। ব্লক কমিটির মিটিং ডাকতে হত। ব্লক কমিটি সম্ভাব্য তিনজনের নাম প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করে জেলায় পাঠাত। জেলা থেকে নাম প্রদেশে যেত। তারপরই প্রার্থী চূড়ান্ত হত।’’
২০১১ সালের ভোটে হারের পরে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছিলেন রজনীকান্তবাবু। সেই সূত্রে বছর দুয়েক আগে কেশপুর কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হন। পরে অবশ্য ওই পদে আসেন কেশপুরের তৃণমূল বিধায়ক শিউলি সাহা। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আর প্রার্থী হননি রজনীকান্তবাবু। কারণ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভোটের মাঠে তো আমি নতুন নয়। কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট হলে কেশপুরে প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু জোটই তো হল না।’
প্রবীণ এই নেতার পিতৃপুরুষের ভিটে দাসপুরের নাড়াজোলের লঙ্কাগড়ে। তবে তিনি থাকতেন মেদিনীপুর শহরের রবীন্দ্রনগরে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়েছিলেন। তার অধীনে শহরের নজরগঞ্জে রয়েছে বৃদ্ধাশ্রম থেকে পুনর্বাসন কেন্দ্র। এ দিন দলমত নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এসেছিলেন কংগ্রেস নেতা তীর্থঙ্কর ভকত, তৃণমূল নেতা শ্যামপদ পাত্র। দুপুরে মরদেহ রাখা হয়েছিল মেদিনীপুরের বাড়িতে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় নাড়াজোলের লঙ্কাগড়ে। সেখানেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। শেষযাত্রার ভিড়েও বোঝা গিয়েছে রজনী অবসানে অনেকেরই মন ভার। সকলেই একবাক্যে মেনেছেন, রজনীদা অন্য ধাতের মানুষ ছিলেন।
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy