Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কম সময়েই সম্পর্কে তিক্ততা, বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের আর্জি

বছর তিন আগে বিয়ে করেছিলেন অর্পিতা রায় (নাম পরিবর্তিত)। স্কুল-শিক্ষিকা অর্পিতা বিয়ে করেছিলেন তাঁর কলেজ-বন্ধুকেই। বিয়ের বছর চারেক আগে থেকে সম্পর্ক ছিল। অবশ্য বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। বছর ঘুরতেই সম্পর্কে ফাটল আসে। তিক্ততা বাড়ে। দু’জনে বুঝতে পারেন, বৈবাহিক সম্পর্কে ইতি টানার সময় চলে এসেছে। পরে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন।

বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫৫
Share: Save:

বছর তিন আগে বিয়ে করেছিলেন অর্পিতা রায় (নাম পরিবর্তিত)। স্কুল-শিক্ষিকা অর্পিতা বিয়ে করেছিলেন তাঁর কলেজ-বন্ধুকেই। বিয়ের বছর চারেক আগে থেকে সম্পর্ক ছিল। অবশ্য বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। বছর ঘুরতেই সম্পর্কে ফাটল আসে। তিক্ততা বাড়ে। দু’জনে বুঝতে পারেন, বৈবাহিক সম্পর্কে ইতি টানার সময় চলে এসেছে। পরে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন। অর্পিতা বলছিলেন, “সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয় বুঝেই আমরা মিউচুয়াল ডিভোর্সের পথে যাই। যে সম্পর্ক থাকার কথা নয়, তাকে জোর করে টিকিয়ে রাখার ইচ্ছে আমাদের দু’জনেরই ছিল না।”

আমাদের চারপাশে এমন ঘটনা এখন আকছার ঘটছে। পরিসংখ্যানও বলছে সম্পর্কে তিক্ততা থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে লাফিয়ে। কয়েক বছর আগেও মেদিনীপুর জেলা আদালতে মাসে ১০-১২টি করে বিবাহ বিচ্ছেদের আর্জি জমা পড়ত। আর এখন সেখানে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে মাসে প্রায় ৮০-৯০টি। গত বছর ডিসেম্বরে যেমন ৮৫টি বিবাহ বিচ্ছেদের আর্জি জমা পড়ে মেদিনীপুর জেলা আদালতে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৮১টি আর্জি জমা পড়ে। কোনও কোনও দিন ৯-১০টি করে আর্জির শুনানিও হচ্ছে। আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, যাঁরা বিবাহ বিচ্ছেদের আর্জি নিয়ে আদালতের দারস্থ হচ্ছেন, তাঁদের বেশিরভাগেরই প্রেমের বিয়ে। কেউ পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করেছেন, কেউ বা পরিবারকে মানিয়ে নিয়েই শুরু করেছিলেন একসঙ্গে পথচলা। কিন্তু মিষ্টি সম্পর্কে তিক্ততা আসতে বেশি সময় লাগেনি।

কেন বাড়ছে বিচ্ছেদের আর্জি?

প্রবীণ আইনজীবী শান্তি দত্তের মতে, ‘‘এখন সম্পর্কে সহিষ্ণুতার বড় অভাব। সেখান থেকেই অনেকে বিয়ে ভাঙার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন। তা ছাড়া, পুরুষ-মহিলা সমানাধিকারের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা মানা হয় না। মহিলারা যত বেশি লেখাপড়া শিখছেন, যত বাইরে বেরোচ্ছেন, বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার প্রবণতা তত বাড়ছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পরিবারের একাংশ পুরুষ, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের অন্য মহিলারা তা মেনে নিতে পারছেন না। এর ফলে, সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।’’ এক আইনজীবী মৃণাল চৌধুরীর মতে আবার প্রেমের বিয়ের ক্ষেত্রে পারিবারিক মতামত গুরুত্ব না পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই অসম সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। মৃণালবাবুর কথায়, ‘‘কোনও ক্ষেত্রে দুই পরিবারের মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কোথাও আবার বাধা হচ্ছে দুই পরিবারের সামাজিক অবস্থানের তারতম্য। এই সব কারণেই একটা সময়ের পর একদা দুই বন্ধুই বুঝতে পারছেন, এই সম্পর্কটা আর কোনও ভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’’

অল্পবয়সীদের বেশির ভাগ এখন দিনভর ফেসবুক আর হোয়াট্সঅ্যাপ নিয়ে মশগুল। এই সব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট থেকে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বও অনেক সময়েই বিয়েতে পরিণতি পাচ্ছে। এ দিকে, দেশ জুড়েই এখন ছোট পরিবারের আধিপত্য। যৌথ পরিবারের দেখা মেলা ভার। মেদিনীপুরের আর এক আইনজীবী তীর্থঙ্কর ভকত এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছে, বিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রে একাকিত্ব একটা বড় কারণ। যৌথ পরিবারে যে সব সমস্যা খুব সহজে মিটে যেত, নিউক্লিয়ার পরিবারে তাই অবসাদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর জন্য অভিভাবকদের একাংশও দায়ী। তাঁরাই ছোট থেকে ছেলেমেয়েদের বেশি করে কারও সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না বলে শেখান। পরবর্তী জীবনে এরা সম্পর্কে মানিয়ে-গুছিয়ে চলতে পারে না।’’

এ নিয়ে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিদ্যার এক শিক্ষিকা অস্মিতা ভট্টাচার্য ব্যাখ্যা করেন, ‘‘নিউক্লিয়ার পরিবারে অল্পবিস্তর ঝগড়াই বড় হয়ে উঠছে। যৌথ পরিবারে এই সম্ভাবনা অনেকটাই কম থাকে। ফলে, বেশ কিছু ক্ষেত্রে সামান্য ভুল বোঝাবুঝিও বড় কোনও সমস্যা তৈরি করছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE